গত এক মাস থেকে মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে অফিস করছেন নিগার সুলতানা। তিনি বলেন, ‘সারাক্ষণ ভয় লাগে। বাসায় বয়স্ক ও শিশু দুই-ই আছে। যদি কিছু হয়ে যায়! কারণ, কেবল আমি নিজে সচেতন হলে তো হবে না, পাশের জনতো নাও হতে পারেন। বেতন কমে যাওয়ার শঙ্কা আছে। আর সবচেয়ে যেটি ভোগাচ্ছে সেটি হলো— টানা এতটা সময় অফিসের চেয়ার-টেবিলে মনোযোগ দেওয়া।’
প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক শওকত হোসেন মাসুম শুরুর দিকে ১৯ এপ্রিল নিজেই করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন উল্লেখ করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই দিন থেকেই তাৎক্ষণিকভাবে প্রথম আলো সম্পূর্ণভাবে হোম অফিস চালু করে। এখন পর্যায়ক্রমে আমাদের অফিস খুলে দেওয়া হচ্ছে। বলা যায়, বড় অংশই আমরা নিয়মিত অফিসে যাচ্ছি। অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে।’
গণমাধ্যমের ঝুঁকি আরও বাড়লো উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এমনিতেই ঝুঁকি ছিল, কিন্তু করোনা সেই ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা আগে থেকেই রূপান্তরের কথা বলছিলাম। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সেটি হয়তো ১০ বছর পরে হতে পারতো, সেটি এখনই করতে হচ্ছে। সেই রূপান্তরের জন্য নতুন নতুন বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু সেই আর্থিক সামর্থ্য করোনা কেড়ে নিয়ে গেছে। সুতরাং বলতে পারি, আমরা মহাসংকটে আছি। এমনকি আমরা জানিও না সামনের দিনগুলোতে কী হবে। সেই সংকট ও অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়েই আমরা কাজ শুরু করেছি। সামনে হয়তো আরও নতুন নতুন সংকট দেখা দেবে।’
টিকে থাকার লড়াইও নতুন মাত্রা পেয়েছে বলে মনে করেন এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। তিনি বলেন, ‘সন্দেহ নেই করোনার কারণে যে বদল, তাতে অনেক ক্ষেত্রেই নতুনভাবে শুরু করতে হবে। আমি প্রিন্টে কাজ করি, কেউ অনলাইনে কাজ করতেন, কেউ ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় কাজ করেন, অনেকে আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় কাজ করছেন, কেউ কেউ মোবাইলেই বড় কাজ করে ফেলছেন। নতুন সময়ে আমাকে এসব শিখতে হবে। সেই প্রস্তুতি আমার কতটা থাকবে, তার ওপরই নির্ভর করবে আগামীতে আমার ও আমাদের টিকে থাকা।’
‘কোনও উৎসব ছাড়াই অফিসে এটা-সেটা খাওয়া ছিল আমাদের প্রিয় আরেকটা কাজ। কখনও বাসার, কখনও বাইরের, কখনো বা বড় আয়োজন করে খাইদাই করাটা ছিল অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু এবার অফিসে ঢুকে মনে হলো সেই পাট মনে হয় চুকলো। যারা এসেছেন সবাই মুখ গম্ভীর করে যার যার সিটে বসে খাচ্ছেন দেখলাম। কেউ কারোরটা ছিনতাই করে খাচ্ছে না। সত্যি কথা বলতে, এতদিন পর অফিসে গিয়ে ভালো যেমন লাগছে, তেমনই এক ধরনের অস্বস্তি বা ভয়ও কাজ করছে। আর এটাও বুঝলাম এভাবে ভয়ে ভয়ে থাকলে কাজ করা খুব কঠিন হয়ে যাবে। যত দ্রুত সম্ভব নিউ নরমাল জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে’, বলেন সাহানা হুদা।
এই ফেরা খুব সহজ হবে না বলে মনে করছেন মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ভয় শঙ্কা নিয়ে বাসায় থাকার কারণে যখন কাজে বের হচ্ছেন, তখন প্রথম প্রথম তাল মেলানো মুশকিল হবে। একদিকে এই ভাইরাস এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে ছড়ায়, ফলে আপনি কারোর ওপরই আস্থা আনতে পারবেন না। আরেকদিকে আপনাকে আপনার অতীতের মধুর স্মৃতি তাড়া করবে। এ দুয়ের মধ্যে আপনি লম্বা একটা সময় পার করতে গিয়ে সম্পর্কে নানা ছেদ ঘটতে পারে। ফলে সবারই অন্যের প্রতি আচরণ প্রদর্শনে সতর্ক থাকতে হবে। যতই হোম অফিস করেন, টানা আট ঘণ্টা একটা টেবিলে বসে থাকতে হয়নি। এতদিন পরে আবারও আট থেকে ১০ ঘণ্টা করে অফিসে থাকাটাও বাড়তি স্ট্রেসের কারণ হতে পারে।’