যেসব কারণে পরীক্ষা দিতে শঙ্কা ১৩ হাজার শিক্ষানবিশ আইনজীবীর

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলকরোনা পরিস্থিতিতে অনেকটাই থেমে গিয়েছিল মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপন। এদের মধ্যে সবচেয়ে করুণভাবে দিনাতিপাত করছেন শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা। স্বাভাবিক পরিবেশে আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত না হওয়ায় এবং বিকল্প পেশায় উপার্জনের সুযোগ না থাকায় ২০১৭ এবং ২০২০ সালের এমসিকিউ উত্তীর্ণ শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা সরাসরি গেজেট প্রকাশ করে তাদের আইনজীবী হিসেবে ঘোষণার দাবি তুলে। তাদের এই দাবিকে ঘিরে পক্ষে-বিপক্ষে উঠে এসেছে আলোচনা-সমালোচনা আর বার কাউন্সিলের ব্যর্থতার চিত্র।
এমসিকিউ (নৈবর্ত্তিক), লিখিত এবং ভাইবা পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের আইনজীবী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পূর্বে কখনও শুধুমাত্র ভাইবা, কখনও আবার লিখিত ও ভাইবা এবং বর্তমানে উক্ত তিন ধাপেই শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণ হতে হয়। কিন্তু আইনজীবীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকায় বার কাউন্সিল কৌশলগতভাবে ২০১১ সালের পূর্ব পর্যন্ত প্রতি বছরে দুটি করে পরীক্ষা নিলেও বর্তমানে ২ থেকে ৩ বছরের ব্যবধানে একটি মাত্র পরীক্ষা গ্রহণ করছে। আবার পরীক্ষা নিলেও তার সকল কার্যক্রম শেষ করতে দেড় থেকে ২ বছর সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। ফলে দীর্ঘদিন ঝুলন্ত প্রক্রিয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে আইন পেশাও তার আভিজাত্য হারাচ্ছে। পাশাপাশি এবার করোনা মহামারি শুরু হওয়ায় উপার্জনহীন শিক্ষার্থীদের আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন অনিশ্চিত হয়ে যায়।

শিক্ষানবিশ আইনজীবী রাশেদ সিকদার বলেন, করোনার কারণে বাধ্য হয়ে আমরা বিভিন্ন দাবিতে এমসিকিউ উত্তীর্ণরা সরাসরি গেজেটের দাবি তুলি এবং ৮০ দিনের অধিক সময় ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছি। কিন্তু আইনত সুযোগ না থাকার অজুহাতে সরাসরি গেজেট দিতে অনড় বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। তারা চাইলেই আইন সংশোধন করতে পারে। করোনাকালে তারা আইনজীবীদের সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা দিয়েছেন। অথচ আমরা একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পরমুখাপেক্ষি হয়ে দিন কাটিয়েছি।

বার কাউন্সিলের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, বার কাউন্সিল পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে এনরোলমেন্ট কমিটি। আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি সভাপতি পদে, সঙ্গে আরও দুজন বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যানসহ মোট ৫ সদস্যের ওই কমিটির পরীক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। বার কাউন্সিল স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের ইচ্ছায় কিংবা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাপে অন্যান্য পরীক্ষা বাতিল করে সরাসরি গেজেট দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে। তবে আইনমন্ত্রী উদ্যোগ নিলে এনরোলমেন্ট কমিটি পরীক্ষা বাতিলের জন্য আ্ইন সংশোধনের উদ্যোগ নেবে বলেও সূত্রটি জানায়।

করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতা:

করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভ আঘাত হানতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার পাশাপাশি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। গত ১৬ সেপ্টেম্বর গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সভায় প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন।

এক শিক্ষানবিশ আইনজীবীর অভিভাবক বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম শাহরিয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, করোনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শঙ্কা উপেক্ষা করে বার কাউন্সিল ১৩ হাজার শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নিতে চায় কিভাবে? এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা করোনা আক্রান্ত তারা তো অন্যদেরও আক্রান্ত করবে। তাদের দ্বারা আবার হাজার হাজার পরিবার করোনায় সংক্রমিত হতে পারে। 

এদিকে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রতিবছর নিয়মিত পরীক্ষা না নিয়ে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের যে জট তৈরি হয়েছে এজন্য বার কাউন্সিলের স্বেচ্ছাচারিতাই একমাত্র দায়ী। তারা আমাদের করোনা পরিস্থিতিতে সারাদেশ থেকে ঢাকায় জড়ো করার মাধ্যমে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চায়। পরীক্ষা দিতে এসে শিক্ষার্থীদের কেউ নতুন করে আক্রান্ত হলে তার দায় কি বার কাউন্সিল নিতে পারবে?

বার কাউন্সিল জানায়, বর্তমানে অ্যাটর্নি জেনারেলসহ এনরোলমেন্ট কমিটির দুজন সদস্য করোনা আক্রান্ত চিকিৎসাধীন আছেন।

লিখিত পরীক্ষার খাতা পরিবর্তনের শঙ্কা:

বার কাউন্সিলের আইনজীবী অন্তর্ভুক্তির লিখিত পরীক্ষা নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে নিজের করুণ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা দেন একজন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলএম (মাস্টার্স) ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া সাবেক ওই শিক্ষার্থী জানান, ২০১৩ সালের পূর্বে সহকারী জজ (জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে) হতে বার কাউন্সিলের লাইসেন্স (অ্যাডভোকেট) থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত বারের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায় জুডিশিয়ারির ভাইবা দেওয়া থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। ওই বছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বমোট ৩৭ জন শিক্ষার্থী বারের লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ছিলো। এরপর মধ্যে ২৭ জন শিক্ষার্থী ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। ওই ২৭ শিক্ষার্থী জুডিশিয়ারির মতো কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেও বারের লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য দেখানো।

তিনি আরও জানান, বার কাউন্সিলের সংশ্লিষ্টরা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে লিখিত পরীক্ষার খাতা বদলে দেওয়ার ঘটনা আমরা আগেও শুনেছিলাম। কিন্তু ছাত্র অবস্থায় তা বিশ্বাস করিনি। তাই নিজেরা ভুক্তভোগী হবার পর আমরা ওই ২৭ শিক্ষার্থী ২০১২ সালে লিখিত পরীক্ষার খাতা রিভিউ চেয়ে আবেদন জানিয়েছিলাম। যা আজ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি।

বহুবছর ধরে বার কাউন্সিলের বিরুদ্ধে চলে আসা লিখিত পরীক্ষার খাতা বদলে অভিযোগ ‘বাতাসি অভিযোগ’ বলে মন্তব্য করেছেন বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও এনরোলমেন্ট কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এসবই বাতাসি অভিযোগ। কেউ কখনও আমাদের কাছে উপযুক্ত প্রমাণ দাখিল করতে পারেনি।

পরীক্ষার খাতা দেখতে ছয় মাসেরও বেশি সময় কেটে যাওয়া:

পূর্বে লিখিত পরীক্ষার খাতা আইনজীবীদের মাধ্যমেই দেখানো হতো। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সময়ে বার কাউন্সিলের আইন পরিবর্তন করে লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখার ভার হাইকোর্টের বিচারপতিদের ওপর ন্যস্ত করা হয়।

কিন্তু মামলা জটের তুলনায় হাইকোর্টের বিচারপতির সংখ্যা কম হওয়ায় কোনও কোনও মামলার রায় লিখতে বছরের পর বছর কেটে যায়। অথচ এরপরও বিচারপতিদের ওপর হাজার হাজার শিক্ষানবিশ আইনজীবী শিক্ষার্থীর খাতা দেখার ভার অর্পণের বিষয়টি ‘অতিরিক্ত চাপ’ বলে মনে করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন আইনজীবী।

২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত বার কাউন্সিলের পরীক্ষা তারিখ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আইনজীবী অন্তর্ভুক্তির প্রথম ধাপ অর্থাৎ নৈর্ব্যক্তিক (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালের ২১ জুলাই। ওই পরীক্ষায় অংশ নেন প্রায় ৩৪ হাজার ৩৮৯ শিক্ষার্থী। সেখান থেকে ১১ হাজার ৮৪৬ জন পরীক্ষার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের জন্য উত্তীর্ণ করা হয়। পরে ২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর তারা লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এরপর প্রায় ৯ মাস পর ২০১৮ সালের ৪ জুন লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। এতে ৮ হাজার ১৩০ জন পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা মৌখিক (ভাইবা) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৮ হাজার ১৩০ জনের মধ্যে থেকে মৌখিক পরীক্ষায় ৭ হাজার ৭৩২ জন পরীক্ষার্থীকে উত্তীর্ণ করে ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর ফলাফল প্রকাশ করে বার কাউন্সিল।

বিচারপতিদের দিয়ে পরীক্ষার খাতা দেখানোর অতিরিক্ত চাপ কমানো প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিষয়টি আলোচনা করে দেখবো। যেটা সবার জন্য সহজ হয় সেই বিষয়টিকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে। 

বয়স বিবেচনায় ভাইবা থেকে বাদ পড়ার ভয়

২০১৭ সালে এনরোলমেন্ট পরীক্ষার ভাইবা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালে। সেই পরীক্ষার ভাইবাতে বাদ পড়া নাম প্রকাশে দুজন শিক্ষার্থী বাংলা ট্রিবিউনের কাছে অভিযোগ করে বলেন, আপিল বিভাগের নির্দেশনা সত্ত্বেও আইনজীবী হওয়ার কোনও বাধা ধরা বয়স বার কাউন্সিল নির্ধারণ করেনি। এরপরও আমাদেরকে ভাইবা বোর্ডে বলা হয় ‘এই বয়সে এসে আপনি আইন চর্চা করবেন কিভাবে? আপনারা যারা জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বয়স পার করেছেন তাদের দ্বারা আইন পেশায় কিছুই দেয়ার নেই’  ইত্যাদি।

শিক্ষার্থী দুজন আরও বলেন, বার কাউন্সিল বয়স নির্ধারণ করবে না, আবার আপিল বিভাগের নির্দেশনা মেনে প্রতি ক্যালেন্ডার ইয়ারে পরীক্ষা নেবে না। ফলে একটি পরীক্ষা থেকে আরেকটা পরীক্ষা আসতে আসতে শিক্ষার্থীদের এমনিতেই বয়স বেড়ে যায়। তাই এই আশঙ্কা থেকেই আমরা বাদ পড়ার ভয়ে এবার করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় এমসিকিউ উত্তীর্ণরা সরাসরি গেজেট প্রকাশের দাবি তুলেছি।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এমসিকিউ উত্তীর্ণদের আইনজীবী হিসাবে সরাসরি গেজেট দেওয়ার দাবি মেনে নেওয়া হবে না বলে উল্লেখ করেন অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। তিনি বলেন, আমরা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আগামীকাল রবিবার (২০ সেপ্টেম্বর) এনরোলমেন্ট কমিটির মিটিং করবো। পরীক্ষা বাতিল হবে না। তবে পরীক্ষা পেছানো হবে কিনা, তা মিটিংয়ে আলোচনা হবে।