বেসিক ব্যাংকে মৃত ব্যক্তির নামে খোলা হলো অ্যাকাউন্ট

বেসিক ব্যাংক লি.

বেসিক ব্যাংকের ফরিদপুর শাখায় মৃত ব্যক্তির নামে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। জেলার নগরকান্দা উপজেলার ছোট শ্রীবর্দী গ্রামের মো. রোকনউদ্দিন আহম্মেদ মারা যাওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় তার নামে এই হিসাব খোলা হয়। ব্যাংক হিসাব খোলার সময়ই তা পরিচালনার জন্য মৃত ব্যক্তির বড় ছেলেকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়। একই দিনে ব্যাংকের পরামর্শে ছেলের নামেও আরও একটি হিসাব খোলা হয়।

জানা গেছে, রোকনউদ্দিন আহম্মেদ গত ১৫ আগস্ট নগরকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি ওইদিন বিকাল সাড়ে ৪টায় হাসপাতালে ভর্তি হলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় মারা যান। এর পাঁচ দিনের মাথায় গত ২০ আগস্ট তার ছেলে মো. ফায়েকুজ্জামানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মৃত বাবার নামে বেসিক ব্যাংকের ফরিদপুর শাখায় ব্যাংক অ্যাকাউন্টটি (হিসাব নম্বর ৪৬১৪০১০০১৭৯৯০) খোলা হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মৃত রোকনউদ্দিনের নামে চেকের মাধ্যমে ইস্যু হওয়া পদ্মা সেতু রেলওয়ে প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণের অর্থ তোলার জন্যই মূলত এই হিসাব খোলা হয়েছে। কাশিয়ানী উপজেলার একটি কলেজের শিক্ষক ফায়েকুজ্জামান তার বাবা মারা যাওয়ার চার দিনের মাথায় গত ১৯ আগস্ট  জেলা প্রশাসন থেকে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৬৩ লাখ নয় হাজার ৫৮৪ টাকার একটি চেক গ্রহণ করেন। রোকনউদ্দিন আহম্মেদের নামে ইস্যু হওয়া চেকটি নিয়ে ওইদিনই ব্যাংকিং সময়ের পরে হিসাব খোলার জন্য বেসিক ব্যাংকে যান।  তবে ব্যাংকের সিস্টেম বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির অফিস ত্যাগ করার কারণে সেদিন ব্যাংক হিসাব না খুলে ফায়েকুজ্জামানকে পরের দিন আসতে বলা হয়। পরদিন ২০ আগস্ট ফায়েকুজ্জামান ব্যাংকে গেলে তার মৃত বাবার নামে সঞ্চয় হিসাব খোলা হয়। এর পরপরই ফায়েকুজ্জামান তার নিজের নামেও ওই ব্যাংকে একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন (হিসাব নম্বর ৪৬১৪০১০০১৮০০১)।

হিসাব খোলার সময় ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে লেখা আবেদনে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের চেক পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়—‘আমার পিতা রোকনউদ্দিন আহম্মেদের নামে আপনার ব্যাংকের শাখায় একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলার জন্য পূর্বে (তারিখ উল্লেখ নেই) তার টিপ সহিসহ হিসাব খোলার ফর্ম জমা দিয়েছি। আমি জ্যেষ্ঠ সন্তান মো. ফায়েকুজ্জামান এ হিসাব পরিচালনার জন্য আমার পিতার কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছি। জেলা প্রশাসক কার্যালয় ফরিদপুর হতে গতকাল ১৯/০৮/২০২০ তারিখে ভূমি/সম্পত্তি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত ক্ষতিপূরণের চেক (টাকা ৬৩,০৯,৫৮৪.০০) আমার পিতার পক্ষে আমি গ্রহণ করেছি। এ পরিস্থিতিতে আমার পিতা রোকনউদ্দিন আহম্মেদের নামে আপনার ব্যাংকের শাখায় একটি সঞ্চয়ী হিসাব খুলে এই অর্থ কালেকশন করার জন্য অনুরোধ করছি।’

‘গ্রাহকের অনুপস্থিতিতে ব্যাংক হিসাব খোলার বিষয়ে ব্যাংকের সহকারী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন গত ২ আগস্ট রোকন উদ্দিন আহম্মেদের বাড়িতে গিয়ে টিপসই সংগ্রহ করেছেন’ উল্লেখ করে আবেদনের সঙ্গে একটি প্রতিবেদনও দেওয়া হয়। শাখা ব্যবস্থাপকের অফিস আদেশের প্রেক্ষিতে ‘সরেজমিনে পরিদর্শন’ করে প্রতিবেদনটি ৩ আগস্ট জমা দেওয়া হয় বলে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়—ওই ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে তাকে শয্যাশায়ী দেখতে পান। তিনি হিসাব খোলার সম্মতির পাশাপাশি ছেলে ফায়েকুজ্জামানকে হিসাব পরিচালনার ক্ষমতা দিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

রোকনউদ্দিন আহম্মেদের ব্যাংক হিসাবে ক্ষতিপূরণের ৬৯ লাখ ৯ হাজার ৫৮৪ টাকার চেক নগদায়ন হওয়ার পর গত ৩ সেপ্টেম্বর ফায়েকুজ্জামানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই টাকা তার বাবার হিসাব নম্বর থেকে নিজের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এরই মধ্যে বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে ব্যাংক থেকে ফায়েকুজ্জামানের হিসাবটি লক করে দেওয়া হয়। বর্তমানে ওই টাকা তার হিসাবেই রয়েছে।

অবশ্য মৃত ব্যক্তির নামে ব্যাংক হিসাব খোলা ও অর্থ হস্তান্তরের বিষয়টি বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নজরে আসায় বিষয়টি অডিট করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এদিকে ফায়েকুজ্জামানসহ প্রয়াত রোকনউদ্দিনের ছেলেমেয়েরা ওই টাকা তোলার জন্য ব্যাংকের স্ট্যাম্পে লিখিত দিয়েছেন। তবে এখন বিষয়টির সুরাহা হয়নি।

রোকনউদ্দিন আহম্মেদের মৃত্যুর পরে ব্যাংক হিসাব যেমন খোলা হয়, তেমনই জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ক্ষতিপূরণের চেকও গ্রহণ করা হয় তার মৃত্যুর পরে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়েকুজ্জামান তার বাবার মৃত্যুর পর ব্যাংক হিসাব খোলার বিষয়টি স্বীকার করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার বেশ কয়েকদিন আগে ব্যাংকের সহকারী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন তাদের বাড়িতে গিয়ে বাবার টিপসই সংগ্রহ করে আনেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০ আগস্ট ব্যাংক হিসাব খোলা হয়।’

বেসিক ব্যাংকের সহকারী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনের অনুরোধে ওই ব্যাংকে হিসাব খুলেছেন উল্লেখ করে ফায়েকুজ্জামান আরও বলেন, ‘বাবার নামে স্থানীয় অগ্রণী ব্যাংকে হিসাব রয়েছে। সেটাও আমিই পরিচালনা করি।’ ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণপ্রাপ্ত এলাকার আরও কয়েকজন তার (আনোয়ার হোসেনের) অনুরোধে বেসিক ব্যাংকে হিসাব খুলেছেন বলে জানান ফায়েকুজ্জামান।

ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বিগত সময়ে পিতার আরও একাধিক ব্যাংকের হিসাব পরিচালনা করে আসছেন উল্লেখ করে তিনি জানান, ‘বাবা শয্যাশায়ী হওয়ার কারণে তার অন্যান্য ব্যাংক হিসাবও তিনি পরিচালনা করেন। এতে তার অন্যসব ভাইবোনের সম্মতিও রয়েছে। সেই হিসেবে বেসিক ব্যাংকেও ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে হিসাব পরিচালনা করছেন। পিতা জীবিত অবস্থায়ই তিনি ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এ কারণেই তিনি বেসিক ব্যাংকের হিসাব খুলেছেন। তবে কোনও ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির কার্যকারতিা যে থাকে না, সেটা তার জানা ছিল না বলে দাবি করেন।

পিতা মারা যাওয়ার পরও জেলা প্রশাসন থেকে তার চেক গ্রহণ এবং ব্যাংক হিসাব খোলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার পিতা মারা যাওয়ার বিষয়টি ডিসি অফিস অবগত রয়েছেন। তবে ব্যাংক জানে কিনা সেটা আমার জানা নেই। আমি নিজে তাদের অবহিত করিনি।’ 

যা বললেন বেসিক ব্যাংকের  ফরিদপুর শাখা ব্যবস্থাপক

বেসিক ব্যাংকের ফরিদপুর শাখার ব্যবস্থাপক মামুনুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনের কাছে দাবি করেন, ‘ওই ব্যক্তির হিসাব খোলার পূরণ করা ফরম গত ৩ আগস্ট ব্যাংকের হাতে এলেও তার ছেলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করার কারণে তখন হিসাব খোলা হয়নি। তিনি ১৯ আগস্ট হাতে চেক পেয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর ২০ আগস্ট হিসাব খোলা হয়েছে।’

মামুনুর রহমান  বলেন, ‘সরকারি টাকা পেয়েছে দেখে আমরা সরল বিশ্বাসে হিসাব খুলেছি। কিন্তু এরই মধ্যে লোকটি মারা গেছেন তা আমাদের জানা ছিল না।’ তিনি জানান, তাদের শাখা থেকে লোকটির বাড়ি ৪০ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় তারা মৃত্যুর বিষয়টি জানতে পারেননি। মৃত ব্যক্তির ছেলে ফায়েকুজ্জামানও বিষয়টি গোপন করেছেন। 

তিনি বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণপ্রাপ্ত বেশ কয়েক ব্যক্তির হিসাব আমাদের ব্যাংকে খোলা হয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ক্ষতিপূরণের অ্যাডভাইস পাওয়ার পর ওই লোকের হিসাব আমরা খুলেছিলাম। উনি উনার ছেলে ফায়েকুজ্জামানকে এই অ্যাকাউন্টের ম্যান্ডেট দিয়েছিলেন। এরই মধ্যে টাকাটা কালেকশন হওয়ার পর জানতে পারি, উনি মারা গেছেন। পরে আমরা উনার অ্যাকাউন্ট ডিফিউজ করে দেই এবং ছেলের অ্যাকাউন্টের ডেবিট লক করে দেই।’

পিতার সঙ্গে ফায়েকুজ্জামানেরও অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম আপনার পিতা আপনাকে ম্যান্ডেট দিলেও এটা আপনি সরাসরি পরিচালনা করতে পারবেন না। আপনার নামেও একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। সেই হিসাবে হস্তান্তর করে পরিচালনা করতে হবে।’

বেসিক ব্যাংকের  ফরিদপুর শাখার এই  ব্যবস্থাপক বলেন, ‘সরকারি টাকা হওয়ার কারণে আমরা সরল বিশ্বাসে এটা করেছিলাম। আমরা জেনেছি, অগ্রণী ব্যাংক নগরকান্দা শাখাও উনার বাসায় গিয়ে অ্যাকাউন্ট করেছে। এ কারণে আমাদের কর্মকর্তা আনোয়ার সাহেব, তার বাড়িও ওই এলাকায়, তাকে পাঠিয়ে টিপসই-সহ ফরম পূরণের কাজ করিয়েছি। কিন্তু ওই সময় ফায়েকুজ্জামান সাহেব ব্যাংকে না আসার কারণে হিসাব খোলা হয়নি। তিনি সরকারি চেক পাওয়ার পর ২০ আগস্ট এসে হিসাব খুলেছেন। আমরা জেনেশুনে মৃত ব্যক্তির নামে হিসাব খুলিনি। সরল বিশ্বাসে খুলেছি। আমরা জানতে পারিনি উনি মারা গেছেন। ফায়েকুজ্জামান সাহেবও তার পিতা মারা যাওয়ার বিষয়টি আমাদের জানাননি। বিষয়টি আমাদের কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে। এর ব্যাখ্যা আমাদের কাছে চেয়েছে।’