গৃহশ্রমিকরা তবে যাবেন কোথায়?

রাবেয়ার মা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) আট বছর ধরে গৃহশ্রমিকের কাজ করেন। সকালে দুই বাসায়, বিকেলে আরও দুটো। ২০২০ সালের মার্চে হঠাৎ শোনেন, কাজ নেই। আবার কবে যোগ দিতে পারবেন সেটাও জানেন না। গ্রামে ফিরে যান সপরিবারে। পাঁচ মাস পর আবার ঢাকায় ফেরেন। ততোদিনে আগের কাজ নেই। কম বেতনে নতুন আরেক বাসায় কাজ শুরু করতে বাধ্য হন তিনি।

কাজপ্রতি ৯ শ’ টাকা করে পাচ্ছেন রাহেমা। বাজার চড়া। কয়েকদিন ধরে মালিককে বলছেন, হাজার টাকা করে দিতে। কিন্তু রাজি নন গৃহকর্তা।

ঢাকার বাসাবাড়িতে ‘ছুটা’ কাজ করেন যারা, তারা এলাকাভেদে কাজপ্রতি সাত শ’ থেকে ১২ শ’ টাকা পর্যন্ত পেতেন। কিন্তু এসব কাজের নেই নিশ্চয়তা, নেই অভিযোগ করার জায়গা। এমনকি অনেকে পান না সাপ্তাহিক ছুটিও। এককথায় গৃহশ্রমিকদের শ্রমিক অধিকার বলতে যেন কিছুই নেই।

গৃহস্থালী কাজে যারা যুক্ত তাদের সংগঠন জাতীয় গার্হস্থ্য শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এক হাজার গৃহশ্রমিকের একটি তালিকা তারা সিটি করপোরেশনে দিয়েছিল। কিন্তু তা কোনও কাজে আসেনি। গৃহকর্মী কারা, আর কারা প্রণোদনা পেলো সেই প্রশ্ন করছেন তারা।

তারা বলছেন, বাংলাদেশ সরকার গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা ২০১৫ প্রস্তত করেছে। যা ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারিতে গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। কিন্তু সেটি এখনও ফাইলবন্দিই আছে।

আয় কমেছে ৭১ শতাংশের

২০২০ সালে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) একটি জরিপ পরিচালনা করে। তারা বলছে, করোনার প্রভাবে শহরাঞ্চলে কর্মহীন হয়েছে ৮০ শতাংশ মানুষ। গ্রামেও সংখ্যাটা একই। নতুন সৃষ্ট দরিদ্রশ্রেণির ৭১ শতাংশের আয় কমেছে।

এদিকে করোনাভাইরাসের প্রকোপে ২০২০ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৪ শতাংশ নারী গৃহশ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।

সুরক্ষা নীতিমালা

বাংলাদেশ সরকার গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা ৭.৩ ধারা অনুযায়ী ১২ বছর বয়সী গৃহকর্মীদের ক্ষেত্রে ‘হালকা ধরনের কাজ’–এর জন্য বৈধ অভিভাবকের সঙ্গে আলাপ করে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে বলে উল্লেখ আছে। তবে ‘এই হালকা’ কাজটা কী, তা পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়নি। ১২ বছরের আগে কোনও শিশুকে গৃহকাজে (অস্থায়ী বা স্থায়ী) নিয়োগের কোনও সুযোগ নেই নীতিমালা অনুযায়ী।

২০১৫ সালের ওই নীতিমালায় গৃহকর্মীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার, বেতন-ভাতা ঠিকমতো পরিশোধ, শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভরণপোষণ, ছুটি ও প্রণোদনাসহ আরও সুবিধাদির কথা স্পষ্ট বলা আছে। আরও বলা হয়েছে, অসুস্থ হলে গৃহকর্মীকে কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে এবং তার চিকিৎসার দায়িত্বও নিয়োগদাতাকে নিতে হবে।

তাদের কথা কে বলবে?

জাতীয় গার্হস্থ্য শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুর্শিদা আখতার নাহার বলেন, গৃহকর্মীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার মানুষ খুবই কম। করোনাকালে স্থায়ী গৃহশ্রমিক ছাড়া বলতে গেলে বাকি সবারই কাজ চলে যায়। গৃহশ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য আইএলও কনভেনশন-১৮৯ অনুসরণ করা জরুরি। প্রণোদনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা দ্বারে দ্বারে এক হাজার কর্মীর তালিকা নিয়ে ঘুরেছি। কোনও লাভ হয়নি।

শ্রমিক নেতা জলি তালুকদার মনে করেন, অনেক শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারাচ্ছে। অনেকে পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। অসংখ্য উদাহরণ আছে, যারা আর কাজে ফিরতেই পারেননি। গৃহশ্রমিকেরা খুব মানবেতর জীবনযাপন করেন। তাঁদের না আছে নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, থাকার জায়গা, সাপ্তাহিক বা মাতৃত্বকালীন ছুটি। নির্ধারিত বেতনও নেই। রাষ্ট্রকেই তাই এই দায়িত্ব নিতে হবে।