২০ বছর পর রাহমানিয়া মাদ্রাসা ফিরে পেলো ওয়াকফ এস্টেট

প্রায় ২০ বছর পর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা ফিরে পেয়েছে ‘জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ মাদ্রাসা ওয়াকফ এস্টেট’। সোমবার (১৯ জুলাই) বিকালে ঢাকা জেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে ওয়াকফ এস্টেট কমিটির কাছে মাদ্রাসাটি বুঝিয়ে দেয়।

এর আগে সোমবার সকালে মাদ্রাসা ভবনে তালা দিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে চলে যান মাদ্রাসাটির মুহতামিম মাওলানা মাহফুজুল হক।

সোমবার বিকাল ৪টার দিকে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘যে মাদ্রাসার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সেটা একটি মসজিদ ও ওয়াকফ এস্টেট। এই ওয়াকফ এস্টেটে আগে বিভিন্ন ইস্যু ছিল। কোর্টে বিভিন্ন মামলা চলমান ছিল। মামলা চলমান থাকার সুবাদে একটি পক্ষ এটার দখলে ছিল।’

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘এই মাসে আমরা ওয়াকফ প্রশাসনের মাধ্যমে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছি যে এখানে যারা অবৈধ দখলদার আছে, তাদের উচ্ছেদ করে নির্বাচিত বৈধ কমিটির কাছে মাদ্রাসার দখল হস্তান্তর করার জন্য। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখানে এসেছি।’

.তিনি বলেন, ‘এখানে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার লোকজন আছেন। এছাড়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক এখানে আছেন।  প্রথমে আমরা যখন এখানে এলাম তখন দেখলাম তালা মারা আছে। ভেতরে কোনও লোকজন পাইনি। যেহেতু সব জায়গায় তালা মারা ছিল, তাই দখল ও হস্তান্তরের স্বার্থে তালা ভেঙে আমরা দায়িত্ব হস্তান্তর করেছি। ওয়াকফ এস্টেট থেকে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাদের আমরা দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছি।’

মাদ্রাসা ভবনটি বুঝে পাওয়ার পর কমিটির সভাপতি ব্যবসায়ী আব্দুর রহীম বলেন, ‘আমাদের বের করে দিয়ে মাওলানা আজিজুল হক সাহেব মাদ্রাসাটি দখলে নিয়েছিলেন। আমরা কাছেই জায়গা ভাড়া করে মাদ্রাসা পরিচালনা করেছি। আর সেই থেকে গত ২০ বছর আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে গেছি।আদালত আমাদের কমিটিকে বৈধ ঘোষণা করেন। আজ জেলা প্রশাসন আমাদের ভবনটি বুঝিয়ে দিয়েছে।’

মাওলানা হিফজুর রহমান এখন মাদ্রাসাটির মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানান আব্দুর রহীম।

জানা গেছে, সর্বশেষ গত ১৮ মে বাংলাদেশে ওয়াকফ প্রশাসন জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ মাদ্রাসা ওয়াকফ এস্টেট  পরিচালনার জন্য ২১ সদস্যের একটি পরিচালনা কমিটি অনুমোদন দেয়। ৩ বছরের জন্য এই কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। কমিটির সভাপতি ব্যবসায়ী আব্দুর রহীম। কমিটির সহ-সভাপতি হারুনুর রশীদ ও আলীমুজ্জামান, সম্পাদক কাজী সাহিদুর রহমান, অর্থ সম্পাদক হাফিজ আব্দুল গাফফার, মাওলানা হিফজুর রহমান, শাইখ মুফতি মনসুরুল হক। কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন— কারি মুজাফ্ফর হুসাইন, ডা. আব্দুল কাইউম, মুজাম্মেল হুসাইন, আকরাম হুসাইন, উমর ফারুক মিল্কী, মুনীর সাঈদ, আলী হুসাইন, ডা. আহসানুল্লাহ, ডা. ইখলাসুর রহমান, আব্দুল হালীম, আব্দুর রব ও হিফজুল বারী।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া জয়েন্ট স্টক কোম্পানির অধীন একটি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান।  ব্যবসায়ী হাজি মোহাম্মাদ আলী ও হাজি মো. নূর হোসেন এই মাদ্রাসার নামে মোহাম্মদপুরে আলী অ্যান্ড নূর রিয়েল এস্টেটে ১০ কাঠা জায়গা ওয়াক্ফ করেন। সেই সময়ের পরিচালনা কমিটি ও জনসাধারণের সহযোগিতায় সেখানে একটি ৫ তলা ভবন নির্মিত হয়। সেখানে প্রায় এক হাজার ছাত্রের শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়।

১৯৯২ সালে হাজি মোহাম্মাদ আলী, মো. নূর হোসেন ও মোহাম্মাদ সাবেদ আলী আরও  ৬ কাঠা জমি ওয়াক্ফ করেন। সেই জমিতে ৫ তলা ভবনটি নির্মাণ হয়। মাদ্রাসার প্রথম মুহতামিম ছিলেন প্রয়াত মাওলানা আব্দুল গাফফার। ১৯৯০ সালের জুনে মাওলানা আলী আসগরকে মুহতামিম নিযুক্ত করা হয়। শায়খুল হাদিস মাওলানা আজীজুল হক মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি একই সঙ্গে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে মাওলানা আলী আসগর পদত্যাগ করলে মাওলানা আজীজুল হককে মুহতামিম নিযুক্ত হন। ধীরে ধীরে মাদ্রাসাটিতে রাজনৈতিক কাজকর্ম যুক্ত করেন তিনি। রাজনৈতিক দলের মিটিং, মিছিল, লং মার্চ ও রোড মার্চে মাদ্রাসার ছাত্র গ্রেফতারও হয়। মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি তখন এ বিষয়ে তাকে সতর্ক করে। মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির চাপে ১৯৯৯ সালের আগস্টে তিনি অধ্যক্ষের পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।

জানা গেছে, সে সময় মাওলানা বাহাউদ্দীনকে অস্থায়ীভাবে মাদ্রাসার মুহতামিম নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০০ সালের ১ জুলাই দিবাগত রাত ৩টার দিকে  মাওলানা আজীজুল হকের ছেলে মাওলানা মাহফুজুল হক, আজীজুল হকের নাতি মাওলানা হাসান আহমদ ও আরেকজন শিক্ষক মাওলানা আশরাফুজ্জামান এবং ছাত্রনেতা জামিল আহমদের নেতৃত্বে তাদের দলের সমর্থকরা লাঠিসোঁটা নিয়ে মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং পরিচালনা কমিটি বাতিলের ঘোষণা দেয়। এ ঘটনার পর মাদ্রাসা কমিটি মাওলানা আজীজুল হককে চাকরিচ্যুত করে। মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা হাসান আহমাদ, মাওলানা আশরাফুজ্জামানকে শিক্ষকতার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

এ সময় মাওলানা আজীজুল হক মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ে একটি ভাড়া বাড়িতে প্রায় একই নামে নিজের ছেলে ও নাতিদের নিয়ে নতুন একটি মাদ্রাসা চালু করেন এবং সেটা চালাতে থাকেন। ওই সময় তিনি চারদলীয় জোটের একজন শীর্ষ নেতা হিসেবে মিটিং-মিছিল করতে থাকেন।

চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার অল্প কয়েকদিন পর ২০০১ সালের ৩ নভেম্বর মাওলানা আজীজুল হক দলীয় ও জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের নিয়ে মেইন গেটের তালা ভেঙে আবারও মাদ্রাসার দখল নেন।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন।

আরও পড়ুন: