সুজেয় শ্যাম থেকে শুরু করে নকীব খান, বাপ্পা মজুমদার, পার্থ বড়ুয়া—কে নেই তালিকায়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ‘মিউজিক এগেইনস্ট করোনা’ উদ্যোগ নিয়ে ৩০ সংগীত পরিচালকের নামে তুলে নেওয়া হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা। এ বিষয়ে কিছুই জানেন না তালিকায় থাকা খ্যাতনামা সংগীত পরিচালকরা। অন্যদিকে, ‘ড্যান্স এগেইনস্ট করোনা’য় কেনাকাটার যে ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে তারও হিসাব মেলে না। এমনকি যাদের নামে চেক লেখা হয়েছে, তিন মাসেও সেসব চেক তাদের হাতে পৌঁছায়নি দাবি করেন অনেক কর্মকর্তা।
৩০ জুন ২০২১ তারিখ দেখিয়ে তৎকালীন সচিবের পরিবর্তে বিধিবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানকৃত সচিবের (সৈয়দা মাহবুবা করিম, পরিচালক, চারুকলা বিভাগ) মাধ্যমে নথি উপস্থাপন করে ৩০ জন সংগীত পরিচালককে প্রদানের লক্ষ্যে একাধিক চেক কাটা হয়।
৩০ জুন ২০২১ (বাজেট বছরের শেষ দিন) তারিখ দেখিয়ে নথি উপস্থাপন থেকে শুরু করে মহাপরিচালকের অনুমোদন করে চেক ইস্যু করা হয়।
সূত্র জানায়, ৩০ জুন রাত ৯টা পর্যন্ত সচিব নওশাদ হোসেন শেষবারের মতো অফিস করেছেন। এরপর বাজেট বছরে সময় থাকে ৩ ঘণ্টা। নওশাদের রেখে যাওয়া চেকের হিসাব বলছে, এই সময়ে ১৬শ’রও বেশি চেক স্বাক্ষর হয়েছে। এ কাজের জন্যই বিধিবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সৈয়দা মাহমুদা করিমকে সচিবের পদে বসানো হয়। যদিও তখন আগের সচিবকে মন্ত্রণালয় বদলি করলেও রিলিজ দেওয়া হয়নি।
একাডেমি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি করোনাকালে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ ছাড়া করোনাকালে শিল্পী ও সংস্কৃতি কর্মীদের নানাভাবে আর্থিক সাহায্য প্রদানও কার্যক্রমে যুক্ত ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অর্থ আগাম তোলা এবং সময় মতো সেটেলমেন্ট না করার অভিযোগ রয়েছে।
নথিতে উল্লেখ করা হয়, একাডেমির করোনাকালীন বিশেষ কর্মসূচি ‘মিউজিক এগেইনস্ট করোনা’র আওতায় ৩০টি মৌলিক মিউজিক তৈরি করার জন্য ৪৫ লাখ টাকা অগ্রিম উত্তোলনের প্রশাসনিক অনুমোদন প্রয়োজন। অনুমোদিত হলে নিম্নলিখিত সংগীত পরিচালকদের অনুকূলে ৪৫ লাখ টাকা এবং অবশিষ্ট ৭ লাখ ২৩ হাজার ১৫৪ টাকা প্রোগ্রাম অফিসার মোহাম্মদ আনিসুর রহমানের অনুকূলে অগ্রিম উত্তোলনের জন্য প্রেরণ করা যেতে পারে।
নথি অনুযায়ী ১ লাখ, দেড় লাখ ও ২ লাখ টাকা করে বরাদ্দ উল্লেখ করা হয়। যার নামে টাকা তোলার অভিযোগ রয়েছে সেই প্রোগ্রাম অফিসার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান কথা বলতে রাজি হননি।
সুজেয় শ্যামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এমন কোনও বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। পার্থ বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এমন কোনও পরিকল্পনার কথা তিনি প্রতিবেদকের কাছেই প্রথম শুনলেন।
নাচেও ‘লুটপাট’
৭৫টি নৃত্য সংগঠনের অংশগ্রহণ দেখিয়ে ‘ড্যান্স এগেইনস্ট করোনা’ উদ্যোগ নিয়ে ৮১ লাখ টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৩০ জুন ২০২১ তারিখ দেখিয়ে তৎকালীন সচিবের পরিবর্তে বিধিবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানকৃত সচিবের (সৈয়দা মাহবুবা করিম, পরিচালক চারুকলা বিভাগ) মাধ্যমে নথি উপস্থাপন করে চার জন কর্মকর্তার নামে তুলে নেওয়া হয় সেই টাকা। ৩০ জুন ২০২১ তারিখ দেখিয়ে নথি উপস্থাপন থেকে শুরু করে মহাপরিচালকের অনুমোদন এবং ক্যাশ চেক ইস্যু করা হয়।
এরমধ্যে যে কর্মকর্তার নামে ৭ লাখ টাকার চেক হয়েছে সেই শামীমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি শুনেছি আমার নামে চেক কাটা হয়েছে। সেটা এখনও হাতে আসেনি। সেটা প্রপস আর কস্টিউমের জন্য বরাদ্দ দেখানো হয়েছে।’
প্রপস আর কস্টিউম আসলেই কেনা হয়েছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অনুষ্ঠানই তো হয়নি। তাই এসব কেনা হয়নি।’
এসব বিষয়ে পরিষদ অবহিত কিনা প্রশ্নে রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘এসবে যদি বিন্দুমাত্র সত্যতা থাকে তবে সত্যিই বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে।’
শিল্পীদের না জানিয়ে তালিকা করা এবং গত বাজেটের টাকা আগে তুলে রেখে এ বছর ব্যবহারের সুযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে তো সেই সংগীত পরিচালকের সম্মতি নিতে হবে। তারা জানেই না। আর আপনি তালিকা করে টাকাও তুলে নিলেন। এ তো মহাদুর্নীতি।’
করোনার সময়ে ৩০ ধরনের নৃত্য উপযোগী ৩০ জন সংগীত পরিচালক নির্ধারণ করা হয়। কথা বলে জানা গেছে, এ ব্যাপারে শিল্পীরাই অবহিত নন। ঘটনাও চার-পাঁচ মাস আগের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্পকলার মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটার প্রস্তাব এসেছিল মৌলিক গান তৈরির জন্য। নৃত্যধারা তৈরি করা ছিল প্রস্তাবের উদ্দেশ্য। আমি গতকাল জানতে চেয়েছি এটি এখন কোন পর্যায়ে আছে। তারা জানিয়েছে বেশি সময় লাগবে না।’
প্রত্যেকে অবহিত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নৃত্য ও সংগীত বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে তারা অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে জানাবেন। যদি কেউ মনে করে কাজটি করবে না, তা হলে করবে না।’
‘মিউজিক এগেইনস্ট করোনা’র নামে ৪৫ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে বলতেই তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘সেটার সুযোগ নেই। মিউজিক ডিরেক্টরদের নামে চেক। যদি তারা কাজ না করে তবে ফেরত আসবে। অডিটে ধরা পড়বে।’
সংগীত পরিচালকদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। সেটা প্রথম ধাপে হওয়া উচিত ছিল কিনা জানতে চাইলে লিয়াকত আলী লাকী আবারও একই কথা বলেন।
চেকগুলো ওপেন চেক, অ্যাকাউন্ট পে নয় কেন প্রশ্নের জবাবেও লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘এটা তো অ্যাকাউন্ট পে হওয়ার কথা। সিস্টেমে আমার চেক দেখার কোনও সুযোগ নেই।’
মিউজিক এগেইনস্ট করোনায় যে ৩০ সংগীত পরিচালকের নাম তালিকা করে বরাদ্দকৃত টাকা তোলা হয়-
- সুজেয় শ্যাম ২ লাখ টাকা
- আলম খান ২ লাখ টাকা
- শেখ সাদী খান ২ লাখ টাকা
- ফুয়াদ নাসের বাবু ২ লাখ টাকা
- কাজী আফতাব উদ্দিন হাবলু ২ লাখ টাকা
- মানাম আহমেদ ২ লাখ টাকা
- বাপ্পা মজুমদার ২ লাখ টাকা
- পার্থ বড়ুয়া ২ লাখ টাকা
- এস আই টুটুল ২ লাখ টাকা
- নকীব খান দেড় লাখ টাকা
- ইবরার টিপু দেড় লাখ টাকা
- মকসুদ জামিল মিন্টু দেড় লাখ টাকা
- ইমন সাহা দেড় লাখ টাকা
- ইবনে রাজন দেড় লাখ টাকা
- রেজওয়ান আলী লাভলু দেড় লাখ টাকা
- শেখ জসীম দেড় লাখ টাকা
- সানি জোবায়ের দেড় লাখ টাকা
- বিনোদ রায় দেড় লাখ টাকা
- তানভীর আলম সজীব দেড় লাখ টাকা
- আনিসুর রহমান তনু দেড় লাখ টাকা
- শান সায়েক এক লাখ টাকা
- সানী চাকী এক লাখ টাকা
- আলাউদ্দিন জাকী এক লাখ টাকা
- রোকন ইমন এক লাখ টাকা
- এজাজুর রহমান এক লাখ টাকা
- কমল খালিদ এক লাখ টাকা
- বিপ্লব বড়ুয়া এক লাখ টাকা
- রিপন খান এক লাখ টাকা
- উজ্জ্বল সিনহা এক লাখ টাকা
- তানভীর দাউদ রনি এক লাখ টাকা
মোট ৪৫ লাখ টাকা
আরও পড়ুন
কিছুই তোয়াক্কা করছেন না শিল্পকলার ডিজি
শিল্পকলার ডিজির বিরুদ্ধে অনিয়ম করে ২৬ কোটি টাকা উত্তোলনের অভিযোগ, তদন্তে মন্ত্রণালয়