আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে কী ভূমিকা রাখছে কমিশন?

আজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। ‘বৈষম্য ঘোচাও, সাম্য বাড়াও/ মানবাধিকারের সুরক্ষা দাও’— প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশেও মানবাধিকার দিবস পালন করা হবে। কিন্তু দেশের মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নীত করার বিষয়ে কথা হলেও এ নিয়ে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেই। দেশে আগের মতোই গুম বা কথিত বন্দুকযুদ্ধ ঘটেই চলছে। সংঘালঘু নির্যাতন, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন, রাজনৈতিক অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে।

তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দাবি, দেশে ক্রমান্বয়ে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নীত হচ্ছে। এ জন্য নানান কাজ চলছে। স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েদের অংশগ্রহণে রচনা প্রতিযোগিতা, তরুণদের জন্য মানবাধিকারের কোর্সের আয়োজন করা হচ্ছে। একইসঙ্গে অভিযোগ নিষ্পত্তির হারও বেড়েছে।

কিন্তু মানবাধিকারকর্মীদের অভিযোগ, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। গুম-খুন, বন্দুকযুদ্ধ বা মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের আগ্রহ কম। তদন্তের এখতিয়ার নেই বলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এসব বিষয় এড়িয়ে যায়। মানুষের কথা বলার অধিকার কিংবা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের মতো গুরুতর বিষয় নিয়েও মানবাধিকার কমিশন কোনও কথা বলে না।’

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে তবু মানবাধিকার কমিশন থেকে এসব জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথাবার্তা বলা হতো, এখন তাও বলা হয় না। যদিও জন্মলগ্ন থেকে মানবাধিকার কমিশন এখন পর্যন্ত এমন কোনও ভূমিকা রাখতে পারেনি, যে কারণে আমরা বলতে পারি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পরিস্থিতি উন্নয়নে চেষ্টা করছে।’

নূর খান লিটনের মন্তব্য, “গুম-ক্রসফায়ার প্রসঙ্গে আগে দুই-একটি কথা যাও বলা হতো, এখনও সেসবও মিয়ম্রাণ। কিছুই বলা হচ্ছে না বললেই চলে। কমিশনটা অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের একটা ক্লাবে পরিণত হয়েছে। যদিও তাদের ক্ষমতা থাকার পরও প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে তাদের প্রস্তাবগুলো সংসদে উত্থাপন করতে পারেনি। তারা কথায় কথায় বলে, ‘আমাদের ক্ষমতা নেই।’ কিন্তু মানবাধিকার কমিশন নাম দিয়ে যতটুকু প্র্যাকটিস করা যায় সেটুকুও তারা করতে পারে না।”

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি সূত্র বলছে, কমিশন থেকে মাঝে মধ্যে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বা নিজেরা আমলে নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেন। সেসব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠানো হয়। তবে মন্ত্রণালয় কমিশনের প্রতিবেদনকে আমলে নেয় কম। শুরু থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মাত্র দুটি ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনায় কমিশনের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মামলার সুপারিশ করে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেসবও আমলে নেওয়া হয়নি। আগের কমিশন গুম-খুন-বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে কিছুটা সোচ্চার থাকলেও বর্তমান কমিশন চলছে অনেকটা ধীরগতিতে।

সূত্রটি জানায়, কমিশনে গত ১০ বছরে প্রায় ৯ হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়েছিল। এর অর্ধেক অভিযোগের কোনও সুরাহা হয়নি। এর মধ্যে গুম, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন, ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদেনের জন্য অনেক অভিযোগ অনিষ্পত্তি অবস্থায় দিনের পর দিন পড়ে আছে। বুধবার (৮ ডিসেম্বর) কমিশন উদ্যোগী হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরাক্ষা বিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেছে। কিন্তু এর কার্যকর কোনও ফল আসেনি।

যদিও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগমের দাবি, ‘আমাদের প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্ত্রণালয় যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে আমরা সাড়া পেয়েছি। চলতি বছর আমরা নিজেদের দুটি বেঞ্চের একটি থেকে ৩২৯টা ও আরেকটি থেকে ১৫৯টি প্রতিবেদন পেয়েছি। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ৬৫ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।’

গুম-খুন-বন্দুকযুদ্ধ প্রসঙ্গে কমিশনের চেয়ারম্যান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আপনারা আমাদের আইনগুলো পড়বেন। আর কোনও প্রশ্ন নেই, আপনারা সবাই শুধু গুম-খুন-বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন করেন। আমাদের আইনে বলা আছে, এসব বিষয়ে আমরা সরাসরি মামলা নিতে পারি না। আমরা প্রতিবেদন চাই। আমরা বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করি না। আমরা প্রতিবেদন চাই। প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট না হলে তদন্ত করাই।’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে দেশের মানুষ যেভাবে দেখতে চেয়েছে, সংস্থাটির যে কর্মচাঞ্চল্য কিংবা কর্ম-দক্ষতা যেটি দৃশ্যমান হওয়া উচিত ছিল, সেটি ক্রমে একেবারে ম্রিয়মান হয়ে গেছে। যে প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের ভরসাস্থল হওয়ার কথা ছিল সেটি আর হয়ে উঠতে পারেনি। নাগরিকদের মনে সেই জায়গাটা আর নিতে পারেনি কমিশন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, ‘বিদায়ের আগে আমি বলেছিলাম, আমি একটা উচ্চমান বজায় রাখার চেষ্টা করেছি যেন পরবর্তী কমিশন সেই ধারা অব্যাহত রাখে। কিন্তু সেটি আর হয়নি। কমিশন অনেকটা আমলানির্ভর হয়ে গেছে।’

‘পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি একবিন্দুও’

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির একবিন্দু উন্নতিও হয়নি, বরং ক্রমেই ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাচ্ছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির একবিন্দুও উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচন প্রক্রিয়া, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা– কোনও কিছুই তো নেই। গুম-খুন বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনাও চলছে। পুরনো কোনও ঘটনার বিচারও হয়নি। তাহলে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয় কী করে?’

ড. শাহদীন মালিকের মতে, ‘আমাদের যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রয়েছে, তাদের তো আইনের মাধ্যমেই খোঁড়া করে রাখা হয়েছে। তাদের শুধু সুপারিশ করার ক্ষমতা আছে। আগে তবু কমিশন থেকে কথাবার্তা বলা হতো, তা ফলপ্রসু হতো কিনা জানি না। এখন তো সেরকম কিছুও দেখি না।’

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে হয়তো একটু উন্নীত হয়েছে। কিন্তু মূল যে শঙ্কার জায়গা– নাগরিক-রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আগের তুলনায় অনেক সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে গণমাধ্যমও সেল্ফ-সেন্সরশিপে চলছে। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য উদ্বেগের জায়গা। এটা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়, পুরোপুরি অনভিপ্রেত।’

ড. মিজানুর রহমানের কথায়, ‘বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ডসহ গুম-খুনের বর্তমান হার হয়তো একটু কম। কিন্তু এমন অপরাধ সভ্য সমাজে একটিও ঘটা উচিত নয়। সেক্ষেত্রে আমরা এখনও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাইনি। এজন্য এদিকে আমাদের আরও কিছু করার সুযোগ আছে।’

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, “সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানবাধিকার পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে। কখনও কখনও মনে হয় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। কখনও দেখা যায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে হত্যাকাণ্ড কিংবা গুমের ঘটনা কমে আসছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই দেখা যায় এগুলো বাড়ছে। এসব ছাড়াও সংখ্যালঘু নির্যাতন-নিপীড়ন বহাল আছে, জমি-জায়গা দখল ইত্যাদি বিষয়ও চলমান।”

নূর খান লিটনের মতে, ‘মানুষের কথা বলার যে স্বাধীনতা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি বহমান, সেল্ফ সেন্সরশিপ সংবাদকর্মীদের মধ্যে যেমন বহমান, তেমনি সমগ্র সমাজেই এটি বহমান। ফলে মানুষের যে মৌলিক অধিকার, সে যে কথা বলবে, সেই সাহস তারা হারিয়ে ফেলেছে। এটি জবাবদিহিতাকে নিশ্চিত করে না। বরং এটি কর্তৃত্ববাদী শাসনকে পাকপোক্ত করছে। এভাবে কখনও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।’ 

মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নীত করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন মনে করেন ড. শাহদীন মালিক। তার অভিমত, ‘রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমেই সবকিছু পরিচালিত হয়। তাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া মানবাধিকার পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে না।’