নষ্ট হচ্ছে বিনামূল্যের পাঠ্যবই

দেশের মেট্রোপলিন সিটির বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসগুলোতে বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ের স্তুপ জমেছে। বছরের পর বছর এসব বই পড়ে থাকায় নতুন বই রাখার জায়গা হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বছরের পর বছর পড়ে আছে অব্যবহৃত এসব বই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা না থাকায় শিক্ষা অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, মজুত থাকা পুরনো সব পাঠ্যবই বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ২০২০ সালে নির্দেশনা দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী, জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা আহ্বায়ক এবং শিক্ষা কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রকাশ্য নিলামে ১০ টাকা কেজি দরে বই বিক্রির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।  ওই নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জমে থাকা বই বিক্রি করে দেওয়া হয়।

কিন্তু মহানগর পর্যায়ে কোনও নির্দেশনা না থাকায় বছরের পর বছর অব্যবহৃত পাঠ্যবইয়ের স্তুপ জমছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস এবং জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে। রাজধানীর কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে বিপুল পরিমাণ পুরনো বই রাখা হচ্ছে।

যে কারণে বইয়ের স্তুপ

বিনামূল্যের বইয়ের আনুমানিক চাহিদাপত্র দেওয়ার পর সেই সংখ্যক শিক্ষার্থী না থাকায় প্রতি বছর অতিরিক্ত পাঠ্যবই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে থাকছে। আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে আনুমানিক যে চাহিদা দেয়, বই নেওয়ার সময় তা নেয় না, ফলে শিক্ষা অফিসেও জমছে পাঠ্যবই।

অভিযোগ রয়েছে, মহানগর পর্যায়ে বেশকিছু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত বইয়ের চাহিদা দিয়ে বই নেয়নি। এছাড়া কিন্ডার গার্টেনগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত চাহিদা দেয়। এভাবে গত কয়েক বছরে জমেছে বইয়ের স্তুপ। অনেক প্রতিষ্ঠান বই রাখার জায়গা না থাকায়, তা বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে।

থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের প্রস্তাব

মহনগরের থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে ২০২০ সালে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবসহ এ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান চাওয়া হয়েছে। 

মোহাম্মদপুর থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়, ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে সরকারের সরবরাহ করা বিনামূল্যের পাঠ্যবই ইবতেদায়ি, দাখিল ও মাধ্যমিক (বাংলা ভার্সন) পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক  গ্রহণ এবং তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করে যাচ্ছে তারা।

প্রস্তাবে আরও বলা হয়, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য চাহিদার ভিত্তিতে আমরা প্রতি শিক্ষাবর্ষে এনসিটিবি বরাবর পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা পাঠাই। পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের আগাম পাঠ্যবইয়ের চাহিদা পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাহিদা পাঠায়। ফলে প্রতি শিক্ষাবর্ষে কিছু উদ্বৃত্ত পাঠ্যবই গোডাউনের একটি বড় অংশ দখল করে আছে।

উদ্বৃত্ত পাঠ্যবই বিধি মোতাবেক টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রির অনুমতি পেলে গোডাউনে পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যাবে।

অভিযোগ আছে, থানা শিক্ষা অফিসের এ প্রস্তাবের বিষয়ে ওপরমহল থেকে কোনও সুরাহা করা হয়নি।

বই নিয়ে বেকায়দায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

জানা গেছে, গত ২০২১ সালের জন্য যে পরিমাণ বইয়ের চাহিদা দিয়েছিল বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সে পরিমাণ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি করোনা পরিস্থিতির কারণে। এছাড়া বিগত বছরগুলোতে কিছু অতিরিক্ত বইও জমা হয়ে আছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিদ্যমান শিক্ষার্থী সংখ্যার ভিত্তিতে পরবর্তী বছরের বইয়ের আগাম চাহিদা দেয়। পরবর্তী বছরের বাস্তবতায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগের দেওয়া চাহিদার তুলনায় কম বা বেশি হয়। এভাবে কোনও কোনও প্রতিষ্ঠানে কিছু বই বাড়তি থেকে যায়। এই পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা বইগুলো পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায়  অযত্নে নষ্ট হচ্ছে। সংরক্ষণের জায়গা না থাকায় থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারাও এসব বই ফেরত নিতে চাচ্ছেন না।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ্ বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিকের মতো, বিদ্যালয় থেকে বই সংগ্রহ করে নিতে পারে কর্ণফুলী পেপার মিল। এতে বই সংগ্রহ ও বিতরণে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। সরকারি কাগজকলকে বিনা পয়সায় বই দেওয়া যেতে পারে।’

অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ্ আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানকে বই বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হলে তা নিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। বেশি করে আগাম চাহিদা দেওয়াও বন্ধ হবে না।  তাছাড়া সরকারি কাজগকলে বই দেওয়া হলে কোনও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বাইরে আর বই বিক্রির সুযোগ থাকবে না। বিনামূল্যের পাঠ্যবই চাহিদা দেওয়া ও বিতরণে শৃঙ্খলা ফিরবে।’

সরকারি প্রাথমিকে সমস্যা নেই

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বই নিয়ে সমস্যা নেই। কারণ, বই জমা হলে তা কর্ণফুলী কাগজকলকে দেওয়া হয়। প্রাথমিকের ঢাকা বিভাগীয় উপরিচালক মো. ইফতেখার হোসেন ভূঁইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারি প্রাথমিকে কোনও সমস্যা নেই। তারপরও যে বই বেঁচে যায়, তা কর্ণফুলী পেপারমিলে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তাছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বই নেওয়ার ক্ষেত্রে সাবধান থাকে। তবে কিন্ডার গার্টেনগুলো বই নিয়ে নষ্ট করায় এ বছর কিন্ডার গার্টেনে প্রথম দফায় ৫০ শতাংশ বই সরবরাহ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু বই তাদের সরবরাহ করা হবে।’