জীবনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন মহসিন খান

‘মামা, দরজা খোলা হাতলের হ্যান্ডেল চাপ দিয়ে ভেতরে ঢুক’—বাসায় প্রবেশের দরজায় সাঁটানো কম্পিউটার কম্পোজ করা এই লেখা। ধানমন্ডির একটি বহুতল ভবনের পঞ্চম তলার এই ফ্ল্যাটটিতে একাই থাকতেন আবু মহসিন খান। যিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভে এসে মাথায় গুলি করে ‘আত্মহত্যা’ করেছেন। পোশাক শিল্পের এই কাঁচামাল ব্যবসায়ী চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর। তার আত্মহত্যার খবরে বুধবার (২ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত গভীর রাত পর্যন্ত বাসাটির সামনে ভিড় জমেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও গণমাধ্যমকর্মীদের। সেই সঙ্গে পদচারণা ছিল আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদেরও।

পুলিশ জানিয়েছে, দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে ড্রয়িং রুমে চেয়ারে বসা অবস্থায় মরদেহটি দেখা গেছে। মাথার ডানপাশে গুলিবিদ্ধ, রক্ত পড়ছিল। সেখানে ছিল তার লেখা বেশ কিছু নোট। পুলিশ স্বজন এবং উপস্থিত অন্যদের সঙ্গে কথাও বলেছে। রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান ঘটনাস্থলে থাকা গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, তিনি বাসাটিতে একাকী জীবনযাপন করছিলেন প্রায় পাঁচ বছর ধরে। তিনি তার নিজের লাইসেন্স করা পিস্তলের গুলিতে নিহত হয়েছেন। ঘটনার সময় বাসায় তিনি একাই অবস্থান করছিলেন। আর এ সময় বাইরের কেউ বাসায় ঢুকেছে, প্রাথমিকভাবে আমরা এসব বিষয়ের কোনও কিছু পাইনি। বিল্ডিংয়ের প্রতিটি জায়গায় সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে, আমরা সেগুলো চেক করেছি। আরও চেক করবো।  ঘটনার পরপরই আলামত সংগ্রহ করেছে সিআইডি।

আবু মহসিন খাঁন

পুলিশ মরদেহের পাশ থেকে একটি সুইসাইড নোট পায়। যেখানে লেখা রয়েছে, ‘ব্যবসায় ধস নেমে যাওয়ায় আমি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। আমার সঙ্গে অনেকের লেনদেন ছিল। কিন্তু তারা টাকা দেয়নি। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’

ফেসবুক লাইভে নিজের শারীরিক অবস্থা, পরিবারের সদস্য ছাড়াও নিজের একাকিত্ব, ব্যবসায় লোকসান, কাছের মানুষের প্রতারণা শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে মাথায় গুলি করে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন আবু মহসিন খান। লাইভের ১৫ মিনিটের মাথায় একটা ফাঁকা গুলি, পরবর্তী সময়ে নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আরেকটা গুলি করেন তিনি, পরে তার মৃত্যু হয়।

আবু মহসিনের স্ত্রী শাহীন আক্তার বিউটি এক ছেলে আফ্রিদী খান নিশানকে নিয়ে থাকতেন অস্ট্রেলিয়ায়। মেয়ে তিনা স্বামী চিত্রনায়ক রিয়াজের সঙ্গে থাকেন বনানীতে।

উপ-পুলিশ কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান আরও বলেন, ২০১৭ সালে মহসিনের ক্যানসার ধরা পড়েছে। তিনি অসুস্থ ছিলেন। প্রাথমিকভাবে আমরা যেটা জানতে পেরেছি, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তার পাওনা রয়েছে। কিন্তু সেসব টাকা চাইতে গেলে তার বিরুদ্ধে অনেকেই মামলা দায়ের করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে একা বসবাস করছেন। জীবনের প্রতি তিনি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন।

মহসিন-খান

তিনি আরও বলেন, ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হবে। পরিবারের সদস্যরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে চাইলে আমরা এ বিষয়ে মামলা নেবো। আইনগতভাবে তাদের যতটুকু সহায়তা করা সম্ভব, আমরা তা করবো। পরিবারের অভিযোগের বিষয়গুলো মামলা দায়ের হলে পরবর্তী সময়ে আমরা জানতে পারবো। 

জানা গেছে, ফ্ল্যাটের ভেতরে তিনি তার কাফনের কাপড়ও রেখে গেছেন। একটি কম্পোজ করা সুইসাইড নোট লিখে রেখে গেছেন।

মহসিনের স্ত্রীর সম্পর্কে বোন এক নারী উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, কয়েক দিন ধরে ফেসবুকে তিনি বেশ কিছু ডিপ্রেশনমূলক স্ট্যাটাস দিতেন। আমরা এসব বিষয়ে তার কাছ থেকে জানতে চাইতাম। আমরা উনাকে বলতাম, আপনি একা তো নন। আপনার মেয়ে বনানীতে আর স্ত্রী ও ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে; তাদের ওখানে চলে যান। আমাদের এসব কথা উড়িয়ে দিতেন। বলতেন, কী আর বলবো তোদের, একা থাকার কষ্ট তোরা বুঝবি না।