উপহারের ঘরে স্বপ্নের জাল বুনছেন তারা

জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় কেটেছে ভাসমান অবস্থায়, ছিল না কোনও স্থায়ী ঠিকানা। আবার কারও কারও ঠিকানার অভাবে নিজ দেশেই ছিল নাগরিকত্বের পরিচয়ও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপহারের আধাপাকা ঘরসহ জমির মালিক হয়ে সবই পেয়েছেন তারা। সেখানেই নতুন করে জীবনের স্বপ্ন বুনছেন একসময়ের গৃহহীন নিম্নআয়ের মানুষগুলো।

ছায়েদ আলী, বয়স ৮০ পেরিয়েছে। সাভারের আশুলিয়া এলাকায় কোনোভাবে একটি ঝুপড়িতে স্ত্রীসহ বাস করতেন। ছেলে-মেয়েরা নিজ নিজ সংসারে ব্যস্ত, চলে গেছেন অন্যত্র। মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে পেয়েছেন ঘর। জীবন সায়াহ্নে এসে আবার নতুন করে সংসারে মেতেছেন এই দম্পতি। নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন সুন্দর জীবনের।

ছায়েদ আলীর সঙ্গে কথা হচ্ছিলো তার নতুন ঘরের বারান্দায়। দিনের বেশিরভাগ সময় সেখানে বসেই কাটান তিনি। মাঝে-মধ্যে আঙিনার খোলা জায়গায় পায়চারী করেন, অপলক তাকিয়ে থাকেন ঘরের দিকে। তার কথায়, ‘সবকিছু এখনও মাঝে-মধ্যে ঘোরের মতো মনে হয়’। নিজের এমন ঘর হবে- কিছুদিন আগেও কল্পনা করেননি তিনি।

শুধু ছায়েদ আলী নন, উপহারের ঘর পাওয়া নিম্নআয়ের সবারই স্বপ্ন ও জীবনযাপনে পরিবর্তন এসেছে। হাঠৎ এমন পরিবর্তনে একদিনে যেমন উচ্ছ্বসিত তারা। অন্যদিকে নতুন করে বাঁচার তাগিদ তাদের মনে। শুধু নিজের ঘর নয়, পুরো প্রকল্প এলাকাই সাজছে তাদের যত্ন ও আবেগে। কেউ কেউতো ঘর বুঝে পাওয়ার আগেই চলে এসেছেন নির্মাণাধীন ঘরের তদারকিতে। তাদেরই একজন বৃদ্ধা আসমা বেগম। তিনি জানান, ঘর পাওয়ার আগে তিনি চরে কুঁড়েঘরে বাস করতেন। সেই জায়গা নতুন ঘর থেকে প্রায় তিন-চার কিলোমিটার দূরে। ঘর বুঝে পাওয়ার আগে সেখান থেকেই প্রতিদিন ঘরের নির্মাণকাজ দেখভাল করার জন্য হেঁটে চলে আসতেন তিনি। ঘরের দেওয়াল আর মেঝে মজবুত করতে নিজের হাতেই ছিটিয়েছেন পানিও।

রেজাউল ইসলাম নামে ৭০ বছর বয়সী আরেক বৃদ্ধ বললেন, ‘ঘর পাওয়ার পর এক মুহূর্তের জন্যও এখান থেকে সইরা যাই নাই।’

ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, যা প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে আশ্রায়ন প্রকল্প ২ এর আওতায় তৃতীয় ধাপে দেশের ৬৫ হাজার ৪৭৪টি গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকে ২ লাখ ৫৯ হাজার টাকা মূল্যের আধা-পাকা ঘর উপহার হিসেবে দিতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আসন্ন ঈদের পর কিংবা আগে প্রধানমন্ত্রী গৃহহীন মানুষের হাতে এই ঘর তুলে দিবেন। এর আগে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩২৯টি। এতে ২ শতক জমির মালিকানাসহ সেমিপাকা দুই রুমের ঘর করে দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে রান্নাঘর, টয়লেট, সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ সংযোগ, আঙ্গিনায় হাস-মুরগি পালন ও শাক-সবজি চাষেরও জায়গা রয়েছে।

1

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও গৃহহীনদের এই খুশি দেখে আবেগে আপ্লুত হয়েছেন। সংসদে এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে তিনি নিজেই আবেগতাড়িত হয়ে বলেন, গৃহহীনদের ঘর দেওয়া আমার জীবনে সব থেকে বড় আনন্দের দিন। একজন মানুষ, যার কিছু ছিল না, তাকে একটা ঘর দিয়ে তার মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি। এর থেকে বড় আনন্দের কিছু হতে পারে না। সেদিন আনন্দে চোখের পানি রাখতে পারিনি। আমি অঝোরে কেঁদেছিলাম। কারণ এটাই তো আমার বাবার স্বপ্ন ছিল।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, আগের দুই পর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতায় মুজিববর্ষের উপহারের এসব ঘরকে অধিকতর টেকসই করতে নকশায় আনা হয়েছে পরিবর্তন। জমি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নেওয়া হচ্ছে বিশেষ সতর্কতা। নতুন একক গৃহ নির্মাণের ব্যয়বরাদ্দও বেড়েছে। তৃতীয় পর্যায়ে প্রতিটি ঘরের নির্মাণ খরচ দুই লাখ ৫৯ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের দুই পর্যায়ে প্রতিটি ঘরের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রথম পর্যায়ে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমার জন্য এই কাজটি একটি হৃদয়ের বিষয়। এত চমৎকারভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে গর্বের একটি প্রকল্প। এর মাধ্যমে একটি মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন হচ্ছে। এর মাধ্যমে টেকসই লক্ষমাত্রার আটটি লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এটি কোনো ট্র্যাডিশনাল কাজ না। এটি প্রতিদিনই রিভিউ হচ্ছে।