নতুন ঘর নিয়ে স্বপ্ন বুনছেন ঘূর্ণিঝড়ে সন্তানহারা ইয়ার মোহাম্মদ

১৯৯১ সালে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে চট্রগ্রামের আনোয়ারার ইয়ার মোহাম্মদের দুই ছেলে ও তার ভাইয়ের দুই ছেলেসহ পরিবারের সাত জন মারা যান। সে সময় পরিবারের সদস্যদের আলাদা করে কবর দিতে পারেননি তিনি। ঘূর্ণিঝড়ে মারা যাওয়া অন্য মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে গণকবর দেওয়া হয় তার স্বজনদের। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে চালিয়েছেন জীবন সংগ্রাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষ উপলক্ষে সারা দেশে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় তৃতীয় ধাপে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে প্রায় ৩৩ হাজার ঘর দিচ্ছেন ঈদের উপহার হিসেবে। ইয়ার মোহাম্মদ তাদেরই একজন। মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি চার উপজেলায় যুক্ত হয়ে ঘরগুলো হস্তান্তরের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন।

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়কে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় বলে আখ্যায়িত করা হয়।  স্বাধীনতার ২০তম বছরে এসে বাংলাদেশ দেখে এই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগের ওপর দিয়ে বয়ে যায় এই প্রলয়ঙ্করী ঝড়টি। এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার। এতে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল। এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। প্রায় ১০ লাখ ঘড়-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এতে প্রায় ১ কোটি মানুষ নিঃস্ব হয়ে যান।

ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে ‘আশ্রয়ণ’ নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। যা প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। রঙিন টিনশেডের প্রতিটি একক ঘরে ইটের দেয়াল, কংক্রিটের মেঝে এবং টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি দু’টি করে শোবার ঘর, একটি রান্নাঘর, টয়লেট এবং সামনে খোলা বারান্দা রয়েছে।

বর্তমান ঘরের সামনে ইয়ার মোহাম্মদএই প্রকল্পের আওতায়  প্রথম পর্যায়ে ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি ৬০ হাজার ১৯১টি, ২০ জুন ৫৩ হাজার ৩০০টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে।  প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মিত মোট ঘরের সংখ্যা ১ লাখ ১৭ হাজার ২৯টি। তৃতীয় পর্যায়ে নির্মাণাধীন একক  ঘরের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৬৭৪টি। এর মধ্যে ৩২ হাজার ৯০৪টি হস্তান্তর হচ্ছে মঙ্গলবার। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বারখাইন ইউনিয়নের হাজিগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্পে গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষের জন্য তৃতীয় ধাপের ১২০টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৩২টি ঘর মঙ্গলবার হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।

ইয়ার মোহাম্মদ জানান, ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনি  বেড়িবাঁধের পাশেই নিজের ঘরে থাকতেন। ঘূর্ণিঝড়ের পর নিজের সন্তান ও স্বজনদের মরদেহ একসঙ্গে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিলেন। কবর খুঁড়তে পারেননি তখন। তার পরিবারের সদস্য ছাড়াও বাইরের আরও মানুষসহ একসঙ্গে লাশ গণকবর দেওয়া হয়। জলোচ্ছ্বাসে সব ভাসিয়ে নেওয়ার পর এক ছেলেকে কাঁধে করে নিয়ে বেড়িয়েছেন। পানির মধ্যেই হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল। পানি নেমে যাওয়ার পর মাটিতেই অবস্থান করেছিলেন। মানুষের কাছ থেকে খাবার সংগ্রহ করেই চলছিল তার জীবন।

তিনি বলেন, ‘বেড়িবাঁধে আবার ঘর বাঁধলাম। প্লাস্টিকে মোড়ানো কাঁচা ঘর। বৃষ্টি আসলেই পানি পড়তো।  কিছুদিন সেখানে থেকে আবার এই হাজিগাঁও সরকারি খাস জমিতে বসবাস করা শুরু করলাম। এখানে আজকে প্রায় ১২ বছর ধরে থাকতেছি।   প্রধানমন্ত্রী ঘর দিচ্ছেন এই জায়গায়, তাই জায়গা ছেড়ে দিয়ে পাশেই একজনের জমিতে কাঁচা ঘর করলাম। সেখানে জায়গার ভাড়া দেই মাসে এক হাজার টাকা। আমার নিজের কোনও জায়গা ছিল না। এখন ঘর পাইছি। ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকবো। অনেক শান্তি লাগতেছে।’

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দেশের ১৯টি উপকূলীয় এলাকায় প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩১ হাজার ৩৭২টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় ধাপে দেওয়া হচ্ছে আরও  ২২ হাজার ৪৬০টি ঘর। সবমিলিয়ে ৫৩ হাজার ৮৩২টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাতে আড়াই লাখেরও বেশি উপকূলের মানুষ পেয়েছেন নিজের একটি স্থায়ী ঠিকানা।