দেশের শিল্পকলায় বঙ্গবন্ধু স্বরূপে আবির্ভূত: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে ইতিহাস থেকে তাঁকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের শিল্পকলায় বঙ্গবন্ধু স্বরূপেই আবির্ভূত, যদিও কোনও কোনও শিল্পী তাঁর রূপায়নে প্রতীক-ইঙ্গিত-রূপকের সাহায্য নিয়েছেন।’

বুধবার (২২জুন) বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের  অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাস রুমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টি আয়োজিত  ‘বাংলাদেশের শিল্পকলায় বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুকে যখন ইতিহাস থেকে নির্বাসন দেওয়ার একটা রাষ্ট্রীয় প্রয়াস শুরু হয়ে যায়, তখন কিছুদিনের জন্য তাঁর প্রতিকৃতি আঁকায় ছেদ পড়লো। তবে তখনও কোনও কোনও শিল্পী তাঁর ছবি এঁকে গেছেন। আবার যখন বঙ্গবন্ধু আপন  মহিমায় বাঙালির জীবনে ফিরে এলেন, তখন তাঁর প্রতিকৃতি আঁকার বা ভাস্কর্য গড়ার চর্চা বেশ প্রবল হয়ে দাঁড়ালো। অর্থাৎ একটা সময় শিল্পকলায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি ছিল অনিয়মিত, অনেকটাই যেন আড়ালে। তারপরও পরম্পরাটা ব্যাহত হয়নি। এই পরম্পরার বিষয়টি প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধুকে ভুলে যাওয়ার যে উদ্যোগ ১৯৭৫ সালের পর নেওয়া হয়েছিল, তা ছিল কতটা অর্বাচীন।’

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আঁকা শিল্পকর্ম উদ্ধার করে সংকলনের ওপরে গুরুত্বারোপ করে সৈয়দ মনজুরুল  বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, ঊনিশ শ’ পঞ্চাশের দশক থেকে তাঁকে নিয়ে নানান শিল্পী কাজ করেছেন, হয়তো এগুলো এখনও আমাদের অগোচরে আছে। এমনকি ১৯৭৫ থেকে নিয়ে পরবর্তী ২০-২১ বছরেও তাঁর প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে, ভাস্কর্যে তাঁর রূপায়ন ঘটেছে। আমরা যেসব শিল্পকর্মের হদিস পেয়েছি, তার পাশাপাশি আমাদের গোচরের বাইরে রয়ে যাওয়া শিল্পকর্মগুলো যদি  উদ্ধার করতে পারি, তাহলে সেসব নিয়ে একটি ভালো সংকলন হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা হতে পারে। আমি আশা করি, কোনও তরুণ গবেষক বা শিল্প লেখক এ কাজটি অচিরেই শুরু করবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু যেসব আদর্শের প্রকাশ ঘটাতেন— তাঁর জীবনে ও কাজে, যেমন- অসাম্প্রদায়িকতা এবং উদার মানবিকতা, সেসব থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই বেশিরভাগ শিল্পী কাজ করেছেন। কিছু শিল্পী যেমন- আবদুল মান্নান অথবা শাহাবুদ্দিন তাঁদের আঁকা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিকে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবেও দেখেছেন। পঁচাত্তরের পর করা বঙ্গবন্ধুকে রূপায়নে প্রতিবাদটি ছিল অশুভ সেই শক্তির বিরুদ্ধে, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, সংবিধান কাঁটাছেড়া করে অসাম্প্রদায়িকতাকে বিসর্জন দিয়েছিল এবং পাকিস্তানপন্থার পুনঃপ্রচলনের চেষ্টা করেছিল।’

শিল্প, সাহিত্যিক ও নন্দনতত্ত্বে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রায় পাঁচ দশক হতে চলেছে। ফলে তাঁর জীবনকালে তাঁকে যারা চিনতেন, তাঁদের সংখ্যা এখন হ্রাস পাওয়ার পথে। আর  দুই-তিন দশক পর সেই সংখ্যা হয়তো শূন্যে নেমে আসবে। কিন্তু যারা তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁকে অনুসরণ করেছেন, তাঁরা যেভাবে তাঁকে তাদের লেখালেখিতে বা শিল্পকর্মে উপস্থাপন করেছেন, তার সঙ্গে যারা কোনোদিন তাঁকে দেখেননি, অথবা যাদের জন্মই হয়েছে তাঁর লোকান্তরিত হওয়ার পর, তাদের লেখালেখিতে বা শিল্পকর্মে মূর্তিমান বঙ্গবন্ধুর অনেক তফাৎ থাকবে, এটি ধরে নেওয়া যায়।’

চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘লেখালেখির মধ্য দিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুকে জানছি। একজন লেখক বা শিল্পী যা তুলে ধরতে পারেন, ইতিহাসবিদের সেই স্বাধীনতা নেই। যিনি আঁকছেন, তিনি ইতিহাসবিদের সীমাবদ্ধা অতিক্রম করার সুযোগ আছে। নিজস্ব অনুধাবনের আলোয় একজন লেখক বা শিল্পী যা তুলে ধরতে পারেন, ইতিহাসবিদের সেই স্বাধীনতা নেই। থাকলেও সেটা গ্রহণযোগ্যতা পায় না।’

বঙ্গবন্ধুকে যিনি সরাসরি দেখে ছবি এঁকেছেন, আর যারা দেখেননি, তারা কীভাবে ছকি আঁকবেন— এমন প্রশ্নে অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘এখানেই কিন্তু একজন বড় মাপের শিল্পীর সঙ্গে একজন সাধারণ শিল্পীর পার্থক্য। আমরা যেসব কাজ রবীন্দ্রনাথের সামনে বসে করা দেখি, আমরা হেমেন  মজুমদারের আঁকা প্রতিকৃতি দেখি, কিংবা অনেক বিখ্যাত বিদেশি শিল্পীও রবীন্দ্রনাথের সামনে বসে ছবি এঁকেছেন। কিন্তু জয়নাল আবেদীন রবীন্দ্রনাথের যে ছবি একেঁছেন, উনি কিন্তু সামনে বসে করেননি। পত্রিকায় মাঝে মাঝে ছাঁপা হতো। কিন্তু দেখে মনে হবে সামনে বসে করা ছবি।  একজন শিল্পী তার সৃজনশীল ক্ষমতার মাধ্যমে সেই শক্তি অর্জন করেন।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টির পরিচালক ও  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক  ফকরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রবন্ধের ওপর  আলোচনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক  সৈয়দ আজিজুল হক। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টির রিসার্চ ফেলো হাসান নিটোল।