মোটরসাইকেল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত কার স্বার্থে?  

গত রোজার ঈদে কয়েক লাখ মানুষ মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরলেও এবারের ঈদে সে সুযোগ থাকছে না। গত ৩ জুলাই সড়ক বিভাগ ঈদের আগে পরে সাত দিন হাইওয়েতে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয়, এক জেলা থেকে অন্য জেলায়ও মোটরসাইকেল চলতে পারবে না- এমন আদেশ দিয়েছে সড়ক বিভাগ। বুধবার (৬ জুলাই) নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিআইডব্লিউটিএ আদেশ জারি করেছে লঞ্চ ও ফেরিতেও মোটরসাইকেল পরিবহন করা যাবে না। ঈদের আগে ও পরে মোট ১১ দিন এই সিদ্ধান্ত অব্যাহত থাকবে। এর মধ্য দিয়ে এবারের ঈদে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফেরার সব পথ বন্ধ হয়ে গেলো। অভিযোগ উঠেছে, পরিবহন মালিকদের সুপারিশেই মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছে পরিবহন মালিকরা।
 
রাজধানীতে গেলো কয়েক বছরে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ের জন্য বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে মোটরসাইকেল। তবে সম্প্রতি গ্রাহক কম পাচ্ছে রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো। বলা হচ্ছে, মূলত বাইকাররা অ্যাপের মাধ্যমে রাইড শেয়ারে যেতে চান না, তারা গ্রাহকের সঙ্গে দামদর করেই সেবা দিতে বেশি আগ্রহী। এই আগ্রহ সেবাকে রাজধানীর বাইরেও নিয়ে গেছে। বিশেষ করে ঈদের সময় মহাসড়কে যানজটে সময় বাঁচাতে এবং টিকিট পাওয়া না পাওয়ার বিড়ম্বনা এড়াতে দূরের পথেও মোটরসাইকেল যাত্রাকেই উত্তম বোধ করেন। এই সুযোগে এক জেলা থেকে অন্য জেলায়, দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তেও চলে মোটরসাইকেল। এতে বিশৃঙ্খলাও দেখা দেয় সড়কে, দুর্ঘটনা তো রয়েছেই।

ঢাকা থেকে নীলফামারীগামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মিজান জানান, পথে যানজটের আশঙ্কায় আমার পরিচিত অনেকেই মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা হয়েছেন। বাসে গেলে জ্যামে বসে থাকতে হয়। কিংবা ফেরিতে সিরিয়ালে থাকতে হয়। মোটরসাইকেল নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায়। তাই অনেকেই এবার মোটরসাইকেলে বাড়ি যাওয়ার চিন্তা করছিলেন। কিন্তু তা তো এবার হচ্ছে না। সরকার মোটরসাইকেলে বাড়ি যাওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, এবার ঈদযাত্রায় দেশের জাতীয় মহাসড়কে ২০ থেকে ২৫ লাখ মোটরসাইকেল চলাচল করতো বলে মনে করছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সমিতি বলেছে, এসব মোটরসাইকেল দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪০ থেকে ৪৫ লাখ ট্রিপ (রাইড শেয়ার) করতো। এতে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ মোটরসাইকেলে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পেতেন। কিন্তু সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে এই মানুষগুলোকে মোটরসাইকেলের পরিবর্তে অন্য যানবাহনে বাড়ি ফিরতে হবে। এই সুযোগটি নেবে পরিবহন মালিকরা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আজ (বুধবার) পর্যন্ত আমাদের সড়কে কোনও চাপ নেই। যাত্রী খুবই কম। তবে আশা করা হচ্ছে আগামীকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে যাত্রীর চাপ বাড়বে। আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।’

বাইকাররা বলছেন, নিয়ম মেনেই তারা রাস্তায় চলাচল করেন। গত ঈদেও সবাই সেভাবেই চলাচল করেছেন। মোটরসাইকেলের কারণে বিভিন্ন সড়কে দীর্ঘ যানজট ছিল না। গণপরিবহনেও ছিল না বাড়তি ভিড়। প্রতি বছর বাসের টিকিটের জন্য যাত্রীদের যে হাপিত্যেস দেখা দেয়, সেটিও দেখা যায়নি। ফলে মানুষের ঈদযাত্রা ছিল নির্বিঘ্ন। এসব কারণেই ঈর্ষান্বিত হয়ে অধিক মুনাফার আশায় পরিবহন মালিকরা মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছে।

বাইকারদের এমন অভিযোগের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘৩ জুলাই সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মিটিংয়ে আমাদের সভাপতি মশিউর রহমান রাঙা এবং আমি নিজেও উপস্থিত ছিলাম না। আমরা এ বিষয়ে কোনও প্রস্তাব সরকারকে দেইনি। আমাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পুরোটাই ভিত্তিহীন।’

খন্দকার এনায়েত বলেন, ‘যদি মালিকদের প্রস্তাবে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তাহলে ওই সভায় আমাদের অবর্তমানে সড়কে বাইক বন্ধ রাখার প্রস্তাবটি দিলো কে? আমার জানা মতে, হাইওয়ে পুলিশের প্রস্তাবেই সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিষয়টি সাংগঠনিক সম্পাদক আমাদের জানিয়েছেন।’ তিনি (সাংগঠনিক সম্পাদক) ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন বলেও জানান খন্দকার এনায়েত।

ঈদের আগে-পরে সড়ক মহাসড়কে বাইক চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক হয়েছে কিনা বা এতে কি সুবিধা হবে- জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
 
বাংলাদেশ হাইওয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, নানা কারণে এবার ঈদের সময় সড়ক মহাসড়কে বাইক চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাইক চালকরা ভারসাম্যহীন অবস্থায় বেপরোয়াভাবে বাস-কারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। বাইক হাইওয়েতে দ্রুতগতির যানবাহন চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে। নিয়ন্ত্রণহীন চলার কারণে মহাসড়কে বাইক দুর্ঘটনা তো রয়েছেই। এ ছাড়াও বাইক সড়ক মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যত্রতত্র পার্কিং করে, এতে সড়কে অন্য যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়। সড়কে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে এবং অযাচিত মৃত্যু রোধে সরকার ঈদের সময় বাইক চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সরকারি এই সিদ্ধান্তটি জনকল্যাণকর মনে করে কয়েক দিনের জন্য এটি মেনে নেওয়ারও অনুরোধ করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।      

এদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, গণপরিবহন সংকটকে কাজে লাগিয়ে ১২ লাখ ট্রিপ যাত্রী রাজধানী ঢাকা থেকে আশপাশের জেলাসহ বিভিন্ন গন্তব্যে মোটরসাইকেলে যাত্রা করতে পারতেন। এসব মোটরসাইকেলে স্ত্রী-সন্তান লাগেজ-ব্যাগেজ নিয়ে ভারসাম্যহীন অবস্থায় বেপরোয়াভাবে বাস-কারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এবারের ঈদে অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে প্রায় তিনগুণ যাত্রী মোটরসাইকেলে যাত্রা করতো বলে ধারণা করা হয়েছিল। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও তিনগুণ বেড়ে যেতে পারতো।