সীতাকুণ্ডে আগুন: এখনও ক্ষতিপূরণ পাননি অনেকে

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বি এম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনার দুই মাস হতে চললেও আহতদের অনেকে এখনও প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। তাদের অনেকেই প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরেও অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। ডিপো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখনও ৫০-৬০ জনের মতো দগ্ধ ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া বাকি আছে।

বুধবার (৩ আগস্ট) ক্ষতিপূরণের সবশেষ খোঁজ-খবরে জানা যায়, দগ্ধ ও হতাহতদের ১০ ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে বলেছে বি এম ডিপো কর্তৃপক্ষ। সেগুলো হলো—চিকিৎসা সংক্রান্ত সব কাগজপত্র, ডিপোতে নিয়ে যাওয়া মালামালের ডেলিভারি চালান, বিল অফ এন্ট্রি, এক্সপোর্টের মাল হলে গার্মেন্টসের প্রত্যয়নপত্র, ইমপোর্টের মাল হলে ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির প্রত্যয়নপত্র, গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স, মারা গেলে মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশ সনদ, প্রত্যেক ওয়ারিশের জাতীয় পরিচয়পত্র/ জন্মনিবন্ধন সনদ, ক্ষমতা অর্পণ/প্রত্যয়নপত্র ও এক কপি করে মৃত ব্যক্তি ও ওয়ারিশগণের/আহত বা দগ্ধ ব্যক্তির ছবি।

এদিকে, ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে বেশিরভাগ কাগজ দিলেও এক ‘প্রত্যয়নপত্র’ নিয়ে আছেন বিপাকে। ডিপো কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নিতে চাইছে না বলে অভিযোগ করেছেন তারা।

এখন পর্যন্ত কতজন সব কাগজপত্র জমা দিয়েছেন, কতজন আংশিক জমা দিয়েছেন এবং কতজন কোনও কাগজ জমা দেননি—এসব তথ্য জানাতে পারেনি বি এম ডিপো কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ছুটিতে থাকায় আগামী সপ্তাহের শেষ নাগাদ এসব তথ্য জানা যেতে পারে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিপো কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় এসব কাগজপত্রের মধ্যে এক্সপোর্টের মালামালের ক্ষেত্রে গার্মেন্টসের প্রত্যয়নপত্র এবং ইমপোর্টের মালের ক্ষেত্রে ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির প্রত্যয়নপত্র নিয়ে বিপাকে পড়েছেন দগ্ধ কয়েকজন। সংশ্লিষ্ট গার্মেন্টস ও ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি না দেওয়ায় তারা ওইসব কাগজ ডিপোতে জমা দিতে পারছে না বলে জানিয়েছেন তারা।

দগ্ধ বদরুজ্জামান রুবেল ও তার ভাই নাজমুল বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, পানামা টেক্সটাইলের মাল আনতে রিজওয়া ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির গাড়ি দিয়ে বি এম ডিপোতে গিয়েছেন। এখন ওই প্রতিষ্ঠান দুটি প্রত্যয়নপত্র দিতে অস্বীকার করছে। ফলে বিল অফ এন্ট্রিসহ অন্যান্য সব কাগজ জমা দিয়েছি ডিপোতে। কিন্তু প্রত্যয়নপত্র ছাড়া কিছুই করার নেই বলে জানিয়েছে বি এম কর্তৃপক্ষ।

আরেক দগ্ধ সুমন হাওলাদার জানিয়েছেন, পানামা টেক্সটাইলের মাল লোড করতে বি এম ডিপোতে গিয়েছিলাম। সেই কাগজসহ সব কাগজ জমা দিয়েছি ডিপোতে। কিন্তু পানামার প্রত্যয়নপত্র ছাড়া সেগুলো গ্রহণ করা হবে না বলে জানিয়েছে তারা। পানামা কাগজটি দিবে না বলে জানিয়েছে।

দগ্ধ সবুজ জানান, অনন্ত জিন্স ওয়্যারের মাল খালাস করতে জনি ট্রান্সপোর্টের গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম ডিপোতে। ডিপোর এন্ট্রি খাতায় নথিভুক্ত করে ভেতরে গিয়েছিলাম। এখন তারা কেউ প্রত্যয়নপত্র দিতে চায় না। এটি ছাড়া অন্য সব কাগজপত্র ডিপোতে জমা দিয়েছি।

রুবেল, সুমন ও সবুজের মতো আরও বেশ কয়েকজন দগ্ধ ব্যক্তি প্রত্যয়নপত্র নিয়ে বিপাকে থাকার বিষয়টি জানিয়েছেন। তারা অন্যান্য কাগজ জমা দিলেও ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বলে জানান। ১৫ আগস্টের মধ্যে প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে হবে বলেও ডেডলাইন দিয়ে দিয়েছে ডিপো কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে বি এম ডিপোর মালিকপক্ষ স্মার্ট গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এখনও ৫০-৬০ জনের মতো দগ্ধ মানুষকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া বাকি আছে। তাদের বিষয়ে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে। তাদের আগে ডিএনএ জটিলতায় থাকা নিহত ১৭ জনের ক্ষতিপূরণের টাকা হস্তান্তর করার চেষ্টা চলছে।

আরেক দগ্ধ নজরুল ইসলাম মণ্ডল ও ভাই কামরুল ইসলাম বলেন, শারমিন গ্রুপের নিজস্ব গাড়িতে তাদের মাল নিয়ে ডিপোতে গিয়েছিলেন। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রত্যয়নপত্রসহ সব কাগজ জমা দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিপূরণ দিতে সময় লাগবে বলে আমাদের জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নজরুলের মতো আরও বেশ কয়েকজন সব কাগজ জমা দেওয়ার পরেও এখনও ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। ডিপো কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়েছে, ক্ষতিপূরণের অর্থ পেতে আরও সময় লাগবে। তবে সেই ‘আরও সময়’ কবে নাগাদ শেষ হবে, তা জানেন না তারা কেউই। এ নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন এসব দগ্ধ মানুষ ও তাদের স্বজনরা।

এদিকে, ডিএনএ শনাক্ত সংক্রান্ত জটিলতায় থাকা পাঁচ জন পুলিশ সদস্য এবং পাঁচ জন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ সদস্যের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা চট্টগ্রাম পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল ২১ জুলাই, সেটিও পিছিয়ে গেছে। আহতদের অবস্থা অনুসারে ২, ৪ বা ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাবেন তারা।

এ বিষয়ে মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী জানান, ডিএনএ পরীক্ষা সংক্রান্ত জটিলতায় অপেক্ষমাণ থাকা ১০ জনের ক্ষতিপূরণের টাকা আগামী সপ্তাহে হস্তান্তর করা হতে পারে। সেটি জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। অন্যদের বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।

প্রসঙ্গত, গত ৪ জুন রাত সাড়ে ৯টার দিকে বি এম ডিপোতে প্রথমে আগুন এবং পরে দফায় দফায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, যা নিয়ন্ত্রণে ৮৬ ঘণ্টা লাগে। ওই ঘটনায় ৫১ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এরমধ্যে ২৯ জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। এসব লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তরও করা হয়েছে। ২২ লাশের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ রিপোর্টের জন্য আটকে থাকলেও গত ৭ জুলাই আট জনের পরিচয় মেলে। এসব লাশও হস্তান্তর করা হয়েছে।

জানা যায়, গত ২০ জুন হতাহতদের মধ্যে তিন ক্যাটাগরিতে ৬৯ জনকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের টাকা হস্তান্তর করে ডিপো কর্তৃপক্ষ। তাদের মধ্যে ৩১ জনই বি এম কনটেইনার ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারী, ফায়ার সার্ভিসের ২৬ জন এবং অন্যান্য আট জন। বাকিদের মধ্যে ডিএনএ পরীক্ষার জটিলতায় ১৪টি লাশের পরিচয় এখনও শনাক্ত হয়নি, তাদের ক্ষতিপূরণও আটকে আছে। অন্যদের তালিকা এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি ডিপো কর্তৃপক্ষ।

স্মার্ট গ্রুপ জানায়, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এখন পর্যন্ত দগ্ধ ৬৯ জনকে ৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। গত ২০ জুন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এই টাকা হতাহতদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিএনএ জটিলতায় মৃত ২০ জনের পরিবারের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের তিন জন বাদে ১৭ জনের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাবে। ফায়ার সার্ভিসের ওই তিন কর্মীকে মৃত ধরে ইতোমধ্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।

তিন ক্যাটাগরিতে ২৬ জনের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ১৩ জনের পরিবারকে ১৫ লাখ করে, বি এম ডিপোর ৯ জন ও অন্যান্য ৪ জনের পরিবারকে ১০ লাখ করে টাকা দেওয়া হয়। অঙ্গহানি হওয়া ১৫ জনের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ৯ জনকে ১০ লাখ করে, বি এম ডিপোর ৩ জন ও অন্যান্য ৩ জনকে ৬ লাখ করে টাকা দেওয়া হয়েছে। দগ্ধ বা আহত ২৩ জনের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ৪ জন, বি এম ডিপোর ১৯ জন ও অন্য একজনকে ৪ লাখ করে টাকা দেওয়া হয়েছে।