X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ড: অপেক্ষায় মালিক ও ক্ষতিগ্রস্তরা

মাহফুজ সাদি
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:০০আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:০০

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বি এম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনার চার মাস পেরিয়ে গেছে। এখনও দগ্ধ-আহতদের অনেকে প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। অনেকে প্রয়োজনীয় সব বা আংশিক কাগজপত্র জমা দিয়েও অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। এ নিয়ে কার্যত কোনও তথ্য না দিতে পারলেও ডিপো চালুর যাবতীয় প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করে প্রতীক্ষার কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বি এম কনটেইনার ডিপোর জেনারেল ম্যানেজার ক্যাপ্টেন (অব.) মাইনুল আহসান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলা ট্রিবিউন। তিনি জানিয়েছেন, ডিপো চালু করতে যত প্রস্তুতি থাকে, তা সম্পন্ন করা হয়েছে। ডিপোটি চালুর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত, কেবল অনুমতির প্রতীক্ষায় আছেন তারা।

মাইনুল আহসান খান জানান, প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ডিপোর সকল ধরনের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে। বিশেষ করে ফায়ারের ক্ষেত্রে তিন স্তরের নতুন সিস্টেম বসানো হয়েছে। এসব নথিপত্র সংযুক্ত করে গত ১১ সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট কাস্টম অফিসে আবেদন করা হয়। এখনও তাদের কোনও রেসপন্স পাওয়া যায়নি, পেলে ডিপো পুরোদমে চালু করা যাবে।

অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিসির মাধ্যমে যে তালিকা এসেছে, তাদের প্রায় সবাইকে আমরা ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়েছি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে প্রতিশ্রুত অর্থ সহায়তা এবং সরকারি ইকুইপমেন্ট কিনে দেওয়া হয়েছে। ডিপোর লোকজনসহ অন্যদেরও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। এ জন্য প্রায় ১৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

ডিপোর ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে জেনারেল ম্যানেজার ক্যাপ্টেন (অব.) মাইনুল আহসান খান বলেন, নিহত স্টাফদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়েছে। তাদের সন্তানরা উপার্জনক্ষম না হওয়া পর্যন্ত সহায়তা দেওয়া হবে। নিহত তিন জনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া যাচ্ছে না ডিএনএ জটিলতায়। আর আহতদের প্রতি মাসে বেতন ঘরে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত অন্য স্টাফদের বিষয়টি দেখতে একটি কমিটিও করা হয়েছে।

সরকারি ও ডিপোর লোকজনের বাইরে দগ্ধ-আহত অনেকে এখনও প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিসি অফিস থেকে যে লিস্ট দেওয়া হয়েছে, তাদের সবাইকে (ডিএনএ জটিলতার ৩ জন ছাড়া) ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। ২০০ শ’র বেশি ক্লেইম এসেছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত নন।

বি এম ডিপোর আগুন-বিস্ফোরণে আহত ও দগ্ধ হয়ে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিয়েছেন অনেকে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালামাল লোড-আনলোড করতে যাওয়া বেশ কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকও রয়েছেন। তারা এখনও ক্ষতিপূরণ পাননি- এমনকি এ বিষয়ে ডিপো কর্তৃপক্ষ কিছুই জানায়নি বলে অভিযোগ করেছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিপোর ম্যানেজার ক্যাপ্টেন (অব.) মাইনুল আহসান খান বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই, খোঁজ নিয়ে জানতে হবে। ওই ঘটনায় আমরাও তো ক্ষতিগ্রস্ত। তারপরও সংশ্লিষ্ট গার্মেন্টসকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছি। কয়েক মাস ধরে আমাদের কোনও আয় নেই, কেবল দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু গার্মেন্টসগুলো কী তাদের শ্রমিকদের কোনও ক্ষতিপূরণ দিয়েছে? তারা তো এই শ্রমিকদের দিয়েই মিলিয়ন ডলার আয় করে থাকে। তবে জেনুইন কোনও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি যদি ক্ষতিপূরণ না পেয়ে থাকেন, সেটি আমরা দেখবো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দগ্ধ ও হতাহতদের ১০ ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে বলেছে বি এম ডিপো কর্তৃপক্ষ। সেগুলো হলো—চিকিৎসা সংক্রান্ত সব কাগজপত্র, ডিপোতে নিয়ে যাওয়া মালামালের ডেলিভারি চালান, বিল অফ এন্ট্রি, এক্সপোর্টের মাল হলে গার্মেন্টসের প্রত্যয়নপত্র, ইমপোর্টের মাল হলে ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির প্রত্যয়নপত্র, গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স, মারা গেলে মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশ সনদ, প্রত্যেক ওয়ারিশের জাতীয় পরিচয়পত্র/ জন্মনিবন্ধন সনদ, ক্ষমতা অর্পণ/প্রত্যয়নপত্র ও এক কপি করে মৃত ব্যক্তি ও ওয়ারিশ, আহত বা দগ্ধ ব্যক্তির ছবি।

গত ১৫ আগস্টের মধ্যে কাগজপত্র জমা দেওয়ার ডেডলাইন দিয়েছিল ডিপো কর্তৃপক্ষ। ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে বেশিরভাগ কাগজ দিলেও সংশ্লিষ্ট গার্মেন্টস ও ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি ‘প্রত্যয়নপত্র’ না দেওয়ায় সেটি ডিপোতে জমা দিতে পারেননি বেশ কয়েকজন। ডিপো কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানালেও আমলে নিতে চাইছে না বলে অভিযোগ করে আসছেন তারা।

দগ্ধ বদরুজ্জামান রুবেল ও সুমন হাওলাদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পানামা টেক্সটাইলের মাল আনতে রিজওয়া ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির গাড়ি দিয়ে বি এম ডিপোতে গিয়েছিলাম। প্রতিষ্ঠান দুটি প্রত্যয়নপত্র না দেওয়ায় বিল অফ এন্ট্রিসহ অন্যান্য কাগজ জমা দিয়েছি ডিপোতে। আরেক দগ্ধ সবুজ জানান, অনন্ত জিন্স ওয়্যারের মাল খালাস করতে জনি ট্রান্সপোর্টের গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম ডিপোতে। ডিপোর এন্ট্রি খাতায় নাম নথিভুক্ত করে ভেতরে গিয়েছিলাম। প্রত্যয়নপত্র না থাকায় বাকি কাগজপত্র ডিপোতে জমা দিয়েছি।

আরেক দগ্ধ নজরুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, শারমিন গ্রুপের নিজস্ব গাড়িতে তাদের মাল নিয়ে ডিপোতে গিয়েছিলাম। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রত্যয়নপত্রসহ সব কাগজ জমা দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিপূরণ দিতে সময় লাগবে বলে আমাদের জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত আর কোনও কিছু জানায়নি তারা। আংশিক কিংবা সকল কাগজ জমা দেওয়া আরও বেশ কয়েকজন দগ্ধ ব্যক্তি একই ধরনের অভিযোগ ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন।

এখন পর্যন্ত কতজন সব কাগজপত্র, কতজন আংশিক কাগজ জমা দিয়েছেন এবং কতজন কোনও কাগজ জমা দেননি, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য জানাতে পারেনি বি এম ডিপো কর্তৃপক্ষ। গত ৩ আগস্ট বি এম ডিপোর মালিকপক্ষ স্মার্ট গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী জানিয়েছিলেন, এখনও ৫০-৬০ জনের মতো দগ্ধ মানুষকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া বাকি আছে। তাদের বিষয়ে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, গত ৪ জুন রাত সাড়ে ৯টার দিকে বি এম ডিপোতে প্রথমে আগুন এবং পরে দফায় দফায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, যা নিয়ন্ত্রণে ৮৬ ঘণ্টা লাগে। ওই ঘটনায় ৫১ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এরমধ্যে ২৯ জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। এসব লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তরও করা হয়েছে। ২২ লাশের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ রিপোর্টের জন্য আটকে থাকলেও গত ৭ জুলাই আট জনের পরিচয় মেলে। এসব লাশও হস্তান্তর করা হয়েছে।

বি এম ডিপো সূত্রে জানা যায়, গত ২০ জুন হতাহতদের মধ্যে তিন ক্যাটাগরিতে ৬৯ জনকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের টাকা হস্তান্তর করে ডিপো কর্তৃপক্ষ। তাদের মধ্যে ৩১ জনই বি এম কনটেইনার ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারী, ফায়ার সার্ভিসের ২৬ জন এবং অন্যান্য আট জন। বাকিদের মধ্যে ডিএনএ পরীক্ষার জটিলতায় ১৪টি লাশের পরিচয় এখনও শনাক্ত হয়নি, তাদের ক্ষতিপূরণও আটকে আছে। অন্যদের তালিকা এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি ডিপো কর্তৃপক্ষ।

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এখন পর্যন্ত দগ্ধ ৬৯ জনকে ৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। গত ২০ জুন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এই টাকা হতাহতদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিএনএ জটিলতায় মৃত ২০ জনের পরিবারের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের তিন জন বাদে ১৭ জনের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাবে। ফায়ার সার্ভিসের ওই তিন কর্মীকে মৃত ধরে ইতোমধ্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।

তিন ক্যাটাগরিতে ২৬ জনের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ১৩ জনের পরিবারকে ১৫ লাখ করে, বি এম ডিপোর ৯ জন ও অন্যান্য ৪ জনের পরিবারকে ১০ লাখ করে টাকা দেওয়া হয়। অঙ্গহানি হওয়া ১৫ জনের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ৯ জনকে ১০ লাখ করে, বি এম ডিপোর ৩ জন ও অন্যান্য ৩ জনকে ৬ লাখ করে টাকা দেওয়া হয়েছে। দগ্ধ বা আহত ২৩ জনের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ৪ জন, বি এম ডিপোর ১৯ জন ও অন্য একজনকে ৪ লাখ করে টাকা দেওয়া হয়েছে।

/এমআর/
সম্পর্কিত
বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের ১ বছর, এখনও ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন সুলতান মাহমুদ
বিএম ডিপো বিস্ফোরণে নেই কারও দায়: ছেলের জন্য এখনও কাঁদেন স্কুলশিক্ষক বাবা
বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণমালিকপক্ষের অবহেলা পেয়েছে ৬ সংস্থা, কিছুই পায়নি ডিবি
সর্বশেষ খবর
আরও কমলো সোনার দাম  
আরও কমলো সোনার দাম  
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
৬ মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর
৬ মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
আরও বিস্তৃত হবে তাপপ্রবাহ, তবে সিলেটে হতে পারে বৃষ্টি
আরও বিস্তৃত হবে তাপপ্রবাহ, তবে সিলেটে হতে পারে বৃষ্টি