মেডিক্যাল প্রশ্নফাঁস চক্রে ১৪ চিকিৎসক, বিপুল সম্পদের খোঁজ

২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল- এই দশ বছরে অন্তত পাঁচবার মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় ৪৪ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি। এই ৪৪ জনের মধ্যে ১৪ জন্য চিকিৎসক পেশায় নিয়োজিত। সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন চক্রের সদস্যরা। অর্থপাচারের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে এই চক্রের সদস্যদের প্রায় ১০০ কোটি টাকার অর্থ-সম্পদের খোঁজ পেয়েছেন তারা। ইতোমধ্যে এই মামলার চার্জশিট প্রস্তুত করা হয়েছে। শিগগিরই আদালতে  চার্জশিট জমা দেওয়া হবে। সিআইডি সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, মেডিক্যাল প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় মানিলন্ডারিং আইনে একটা মামলা হয়েছিল। এই মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। আমরা শিগগিরই আদালতে মামলার অভিযোগপত্র জমা দেবো।

সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর প্রিন্টিং প্রেস থেকে ২০০৬, ২০০৯, ২০১১, ২০১৩ এবং ২০১৫ সালের মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন প্রেসের তৎকালীন মেশিনম্যান আবদুস সালাম। ফাঁস করা সেই প্রশ্ন তার খালাতো ভাই জসীম বিভিন্ন কোচিং সেন্টার এবং তার নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতো। এভাবে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও শত শত শিক্ষার্থী টাকার বিনিময়ে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।

সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রেস কর্মচারী আবদুস সালাম খান ও তার খালাতো ভাই জসীম উদ্দিন ভূইয়ার পারিবারিক চক্রটিতে ছিলেন চিকিৎসক, শিক্ষক, ব্যাংকার, কোচিং সেন্টারের মালিক, শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ নেতা, আবাসন ব্যবসায়ীসহ অনেকেই।

ব্যাংক লেনদেনের তথ্য, উদ্ধারকৃত গোপন ডায়েরি এবং তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে চক্রটির অন্তত ৪৪ সদস্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে ১০ জনই জসীমের আত্মীয়। বাকি ৩৪ জনের ১৪ জন চিকিৎসক এবং দুজন মেডিক্যাল শিক্ষার্থী। সিআইডির তদন্তে এই চক্রের সদস্যরা প্রশ্নফাঁস করে ৯৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

যাদের সম্পৃক্ততা মিলেছে

সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, মেডিক্যাল প্রশ্নফাঁস চক্রে স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর মেশিনম্যান আবদুস সালাম খান এবং তার খালাতো ভাই জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া ওরফে মুন্নু, জসীমের স্ত্রী শারমিন আরা জেসমিন, বড় বোন শাহজাদি আক্তার ওরফে মিরা, দুই ভাই জহিরুল ইসলাম ভূইয়া মুক্তার ও মোস্তফা ভূঁইয়া, তার দুই ভগ্নিপতি আলমগীর হোসেন ও জাকির হোসেন, ভায়রা সামিউল জাফর ওরফে সিটু এবং ভাতিজা এম এইচ পারভেজ খান রয়েছেন।

সিআইডির তদন্ত সূত্র জানায়, এই চক্রের অন্য সদস্যরা হলেন, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা চক্ষু চিকিৎসক ও ফেইথ কোচিং সেন্টারের পরিচালক মুহাম্মদ ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান, তার স্ত্রী ডা. সোহেলী জামান এবং বড় ভাই বোরহান উদ্দিন, শরীয়তপুরের ব্যবসায়ী রাশেদ খান মেনন, মুগদা মেডিক্যালের চিকিৎসক জেডএমএস সালেহীন শোভন, দিনাজপুরের একটি এনজিওর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস হোসেন শেখ, কলেজ শিক্ষক সাজ্জাত হোসেন ও শহীদুল ইসলাম সুজন, আবাসন ব্যবসায়ী আবদুস সালাম ও রওশন আলী হিমু, ঠাকুরগাঁও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি মোতাহার হোসেন, চিকিৎসক নূর আলম রনি, সাবেক টিঅ্যান্ডটি কর্মকর্তা আবদুস সাদেক হাওলাদার, মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. আল মামুন, একটি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী শাকির আহমেদ, টাঙ্গাইলের এভিস কোচিং সেন্টারের পরিচালক কাওছার আহমেদ এবং উজ্জ্বল সরকার, টাঙ্গাইলের চিকিৎসক ইমরুল কায়েস হিমেল এবং তার পিতা স্কুলশিক্ষক আবদুল কুদ্দুস সরকার, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় কর্মরত চিকিৎসক আরিফুল ইসলাম আরিফ, পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসক জিল্লুর হাসান রনি, জসীমের ড্রাইভার নওগাঁর নজিপুরের মাসুদ রানা, খুলনা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র টাঙ্গাইলের নাফিস হাসান রোজ, ঢাকার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের পরিচালক চিকিৎসক কে এম বশিরুল হক, খুলনা থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের পরিচালক চিকিৎসক ইউনুচ উজ্জামান খান তারিম, মুনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজের ক্যাশিয়ার আবদুল লতিফ আকন্দ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসক রুবেল, জসীমের ম্যানেজার মাহমুদুন নবী মজনু, কিশোরগঞ্জের কোচিং ব্যবসায়ী আবু রায়হান, চিকিৎসক কোরবান আলী রনি, মেডিকো  কোচিং সেন্টারের পরিচালক ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ রনি, ব্যাংক এশিয়া থেকে চাকরি হারানো কর্মকর্তা এস এম আহমেদুল হক মনন এবং তার স্ত্রী চিকিৎসক তানিয়া রহমান, জসীমের কর্মচারী নিতাই কুমার বিশ্বাস ওরফে প্রকাশ এবং জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. সোলায়মান হোসেন মেহেদী।

সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, চক্রের সদস্যরা পারস্পরিক যোগসাজশে ডেন্টাল ও মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করত।

বিপুল সম্পদ ও অর্থের খোঁজ

সিআইডি সূত্র জানায়, জসীম উদ্দিন ভূইয়া মুন্নু এবং তার স্ত্রী শারমিন আরা জেসমিনের ব্যাংক হিসাবে প্রায় ২৫ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া জসীম দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ৩২টি দলিলে প্রায় ১৩ একর জমি ক্রয় করেছেন, যার বাজার মূল্য ১৫ কোটি টাকারও বেশি। ঢাকার মিরপুরে পৃথ্বী ভিলা ও শাম্মী মঞ্জিল নামে জসীমের ২টি বাড়ি রয়েছে। যার আনুমানিক  বাজার মূল্য ৩ কোটি টাকা। এছাড়াও ঢাকার মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে ১৯.৬ কাঠার আয়তনের জসীমের মোট ৪টি প্লটের সন্ধান পাওয়া যায়, যার বাজার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। জসীমের মায়ের নামে ৫টি দলিলে ১.৬৫ একর জমির সন্ধান পাওয়া যায়, যার বাজার মূল্য ৫ কোটি টাকারও বেশি। স্ত্রীর নামে ৬টি দলিলে ২.৮৬ একর জমি কিনেছেন, যার বাজার মূল্য ১০ কোটি টাকারও বেশি। এছাড়াও মিরপুর ও সাভারে ৬টি দলিলে ১৩.১৯০৬ একর জমির সন্ধান পাওয়া পেয়েছে সিআইডি, যার দলিল মূল্য ২০ কোটি টাকা হলেও বাজার মূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকারও বেশি।

সিআইডি সূত্র জানায়, প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড আব্দুস সালাম খান। সালাম স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যুরোর প্রিন্টিং প্রেসে ১৯৮৮ সালে মেশিনম্যানের (চতুর্থ শ্রেণি) চাকরিতে যোগ দেন। প্রশ্ন ফাঁস ও অপরাধলব্ধ আয়ে সালাম দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ৬টি দলিলে ২.৫২৫ একর জমি কিনেছেন, যার বাজার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এছাড়াও সালাম তার স্ত্রী নাসরিন আক্তারের নামে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে ১২.৬৮ শতাংশের একটি জমি কিনেছেন।

সিআইডি সূত্র জানায়, জসীমের আপন বড়  বোন শাহজাদী আক্তার ওরফে মীরা। প্রশ্নফাঁসের ক্ষেত্রে ভাই জসীমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করেন শাহজাদী। গৃহিণী শাহজাদীর ব্যাংক হিসাবে প্রায় দুই কোটি টাকার লেনদেন পাওয়া গেছে। এছাড়াও ঢাকার মিরপুরের পল্লবী থানা এলাকায় শাহজাদীর নামে ৩টি জমির প্লট পাওয়া গেছে, যার বাজার মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা। এছাড়াও ৬ তলাবিশিষ্ট একটি নির্মাণাধীন বাড়িরও সন্ধান পাওয়া গেছে তার। এছাড়া জসীমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান ও তার স্ত্রী সোহেলী জামান। জসীম ও ময়েজ মেডিক্যাল ভর্তি কোচিং সেন্টার শুভেচ্ছা, ফেইম, থ্রি ডক্টরস, রেটিনা, প্রাইমেট, এভিস, মেডিকোসহ বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের মালিক, পরিচালক ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় মেডিক্যাল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী সংগ্রহ করতো এবং ফাঁসকৃত প্রশ্ন বিক্রি করতো। ময়েজ ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে প্রায় ২৪ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়াও রাজাবাজারে তাদের ৫ তলা একটি বাড়ি এবং নড়াইলে বিপুল সম্পদের খোঁজ মিলেছে।

সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, এসব ছাড়াও আবদুস সালামের প্রায় ৩ কোটি টাকা, রাশেদ খান মেননের ৯ কোটি, পারভেজের ২ কোটি, সালেহীন শোভনের দেড় কোটি, দীপুর ৫০ লাখ এবং আলমাসের প্রায় ৬০ লাখ টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় মানিলন্ডারিং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মাধবী রানী পাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মামলাটি প্রায় গুছিয়ে এনেছি। এজাহারনামীয় ১৪ জনের বাইরেও বেশ কিছু ব্যক্তির নানা মাত্রার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। শেষ মুহূর্তের যাচাই বাছাই শেষে শিগগিরই আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।