নৌকাডুবির দায় কার?

একটি নৌকা ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ লোক নিয়ে নদী পার হচ্ছে। প্রায় ডুবু ডুবু অবস্থায় ধীরে ধীরে নৌকাটি পার হওয়ার চেষ্টা করছে। একাধিক মানুষ পাড়ে দাঁড়িয়ে সেই প্রায় ডুবন্ত নৌকার পার হওয়া দেখছেন। এ সময় কেউ একজন হ্যান্ডমাইকে বলে ওঠে— ‘এই মাঝি সাবধানতা অবলম্বন করেন’। বাক্যটি দু’বার বলতে বলতে উল্টে যায় নৌকা। চারপাশে তখন চিৎকার ‘এই ধরো ধরো ধরো’। ‘এই ধরো ধরো উঠাও’, এই চিৎকারে শেষ হয় ভিডিওটি। প্রশ্ন হলো, এই নৌকাডুবির দায় কার? দুর্ঘটনা পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করেন যারা, তারা বলছেন— যারা ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ মানুষ নিয়ে নৌকাটি ছাড়ার অনুমতি দিয়েছেন, সেই খেয়াঘাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা, যারা দেখেও গ্রামবাসীকে বলেননি— দুই বারে পার হওয়ার কথা, যারা জোর করে নৌকা ভর্তি করে উঠে দুর্ঘটনাকবলিত হলেন। যারা এই খেয়াঘাটের অনুমোদন দিয়ে মনিটরিংয়ের কোনও ব্যবস্থা করেননি, প্রত্যেকে এর জন্য দায়ী। 

রবিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির সময় পাড় ধারণ করা ভিডিও’র বর্ণনা এটি। নৌকাডুবিতে তাৎক্ষণিক শিশু, নারীসহ ২৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়। মৃতের শঙ্কা বাড়ার আশঙ্কা জানিয়ে কর্তৃপক্ষ বলছেন, নিহতদের মধ্যে ১২ জন নারী, ৮টি শিশু ও ৪ জন পুরুষ। বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জেলার বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরে (নদীর অপর পাড়ে) মহালয়া উপলক্ষে এক বিশাল ধর্মসভার আয়োজন করা হয়। ওই ধর্মসভায় যোগ দিতে জেলার বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের লোকজন শ্যালো মেশিনচালিত একটি নৌকাযোগে মন্দিরে যাচ্ছিলেন। নদীর মাঝপথে অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে নৌকাটি উল্টে যায়।

নৌ-দুর্ঘটনায় প্রতি বছরই অনেক মানুষ আহত, নিহত ও নিখোঁজ হচ্ছেন। এ দেশে বড় ধরনের নৌ-দুর্ঘটনা ঘটলে কিছুদিন হৈচৈ হয়, গণমাধ্যমগুলোও এ নিয়ে কিছুদিন সরগরম থাকে। আর এ জাতীয় নৌ-দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ  যথারীতি গঠন করে  তদন্ত কমিটি। নৌ-দুর্ঘটনার কিছুদিন পর দেশে যদি অন্যকোনও বড় ধরনের ঘটনা বা সহিংসতা, অথবা অন্য কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, তখন স্বাভাবিকভাবেই চাপা পড়ে যায় ওই নৌ-দুর্ঘটনার বিষয়টি। পরবর্তী সময়ে আর কেউ জানতে পারে না, ওই নৌ-দুর্ঘটনার পেছনে দায়ী ব্যক্তি কে, অথবা দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা।

২০২১ সালের জুন মাসে বুড়িগঙ্গা নদীতে মর্নিং বার্ড লঞ্চের ওপর এমভি ময়ূর-২ নামের জাহাজ উঠে গেলে লঞ্চটির ৩৪ যাত্রীর প্রাণহানি হয়। ২০২২ সালের মার্চ মাসে শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গো জাহাজ রূপসী-৯ এর ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এম. এল আফসার উদ্দিন ডুবে ১০ জনের মৃত্যু হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্যমতে, গত ৭ বছরে দেশে ৪ হাজার ৭৯১টি নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৪ হাজার ২৩৮ জনের। আহত হয়েছেন ২ হাজার ৭১৪ জন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা আউলিয়া ঘাটের পানির উচ্চতা উল্লেখ করে বলেন, ‘সেখানে বেশিরভাগ সময় হেঁটেও পার হওয়া যায়। এখন বর্ষা মওসুম। আউলিয়া ঘাটে একটা খেয়াঘাট আছে। আপনারা ভিডিও দেখেছেন, যেখানে মাঝিকে সাবধানে যেতে বলা হচ্ছে। কিন্তু এই নৌকা ঘাট ছেড়ে কীভাবে গেলো। কেউ বললো না, দুইবারে পার হও।’ দায় কার উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘খেয়াঘাটের ডাক হয় প্রতিবছর। সেটার কিছু নিয়ম আছে। ভাড়া কত হবে, একবারে কত জন লোক নেবে, নৌকা ঠিকঠাক আছে কিনা ,দেখার কথা। এসব যারা করেন না এবং যারা নিজেরা এতোগুলো মানুষ চড়ে বসলেন এক নৌকায়, তারা কেউই দায় এড়াতে পারবেন না।’

খেয়াঘাট মনিটরিংয়ের কোনও ব্যবস্থা আছে কিনা প্রশ্নে জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আজকে যেহেতু মহালয়া ছিল সেহেতু পুলিশ, আনসার, জনপ্রতিনিধি খেয়াঘাটে ছিল। তারা লোকজনকে আটকানোর চেষ্টা করেছে। নৌকা ঘাটে ভেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কে কার আগে যাবে, তড়িঘড়ি করে উঠেছে। সাবধান করে লাভ হয়নি।’ কী করে এত যাত্রীসহ নৌকা ছাড়লো, সে বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা একটা কমিটি করেছি। ৩ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটি রিপোর্ট দিলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’