তাজরীনের মামলায় সাক্ষী হালিমা আদালতে হাজির হয়ে বলেছেন, সেদিন আগুন লাগে সময় আনুমানিক সন্ধ্যা পৌনে ৭টা। হঠাৎ নিচের দিক থেকে হৈ চৈ শুনতে পাই। আমরাও আতঙ্কের মধ্য জানতে চাই কী হইছে? উপস্থিত ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আমাদের বলেন, ‘কিছু হয় নাই। সব ঠিক আছে। তোমরা কাজ করো।’ হালিমা বলেন, ‘আমরা কাজ চালু রাখি। এর মধ্যে আগুন আগুন চিৎকার আরও বাড়তে থাকে। ধোঁয়ার সঙ্গে আগুন আমাদের ফ্লোরের সিঁড়ি দিয়ে দাউ-দাউ করে ওপরে ধেয়ে আসতে থাকে। চারদিক ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। নিচে নামতে গিয়ে গেট তালাবন্ধ পাই। সবাই বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার দিয়ে যে যার মতো বাঁচতে চেষ্টা করি। আগুনের তাপ আর ধোঁয়ায় জ্ঞান হারাবার মতন পরিস্থিতি। সবাই মিলে জানালা ভেঙে নিচে লাফ দেই। জীবনটা বাঁচে, কিন্তু চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাই।’
শুধু হালিমা না। মাহফুজা, সবিতা রাণী, পারভীনসহ আরও অনেকে সেদিন বের হতে পারেনি মালিকপক্ষের অবহেলার কারণে। জোর করে তাদের আটকে রাখা হয়। গেটের তালা না খোলার কারণে বেশিরভাগ কর্মী নানাভাবে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। পারভীন এখন থাকেন মধুপুরে। কাজ করার সামর্থ্য নেই। সেই দিন লাফিয়ে পড়ার কারণে মাথায় চোট পান। এখন চোখে দেখেন না। বুকের রোগ এখনও সারেনি। আবার কাজে যোগ দিতে না পারায় ফিরে গেছেন গ্রামে। অন্তত খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে তো পারবেন। সাক্ষী দেওয়ার জন্য তার সঙ্গে আলিয়া নামের একজন যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু মধুপুর থেকে দুই বাচ্চা নিয়ে সাক্ষ্য দিতে আসা তার পক্ষে সম্ভব না। আদালত উকিল পুলিশ কেউই সাক্ষ্য দিতে নিয়ে যেতে কোনও ব্যবস্থা করার বিষয়ে যোগাযোগ করেছিল কিনা, জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ওসব বুঝি না।’
সবিতা রাণী ঘটনার দিন তিন তলা থেকে লাফিয়ে পড়েন। তার মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড আঘাত পান তিনি, হাড় সরে যায়, পায়েও আঘাত পান। তার কোনও আঘাতই এখনও সারেনি। সবিতা বলেন, ‘আমরা বিচার চেয়েছি। কিন্তু কীভাবে আমরা সেটা পাবো, তা কেউ বলেনি। আবার নানা ভয়ও আছে। অনেকে নিষেধ করেছে মুখ খুলতে।’
আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশনস অগ্নিকাণ্ডের এক দশক আজ। ২০১২ সালের এই দিনে এই ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে অন্তত ১১৭ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যান। আহত হন আরও অর্ধশতাধিক শ্রমিক। এ ঘটনায় মামলা হলেও দিনের পর দিন সাক্ষ্যগ্রহণ না হওয়া, দীর্ঘ সময় পরপর শুনানির দিন ধার্য হওয়ায় ১০ বছর পরেও বিচার কাজ সম্পন্ন হয়নি। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন গার্মেন্টেসের শ্রমিকরা নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়লেও এখনও এলাকায় রয়েছেন হাজারও সাক্ষী, যারা সেদিন পুড়ে যেতে দেখেছেন এতগুলো প্রাণ। এমন অনেকেই আছেন সেখানে— যারা শরীরে ক্ষত বহন করছেন। কিন্তু তারপরেও সাক্ষীর অভাবে পিছিয়ে পড়েছে বিচারকাজ। অনেক ভুক্তভোগী কেবল নিরাপত্তার অভাবে আদালতে যেতে ভয় পান। সেই নিরাপত্তা বিধানেও নেওয়া হয়নি কোনও ব্যবস্থা।
এদিকে মামলার অন্যতম আসামি তাজরীনের মালিক দেলোয়ার হোসেন এখন জামিনে রয়েছেন। তিনি ২০১৮ সালে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে এখন ঢাকা উত্তর মৎসজীবী লীগের সভাপতি।
কী ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে
এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করার জন্য ঘটনার পরপরই সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। প্রতিটি অনুসন্ধানেই মালিক-কর্তৃপক্ষের শ্রমিক নিরাপত্তা বিষয়ে সার্বিক অবহেলার চিত্র তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো— স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনের সুপারিশমালায় বলা হয়, ‘তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেডে সংঘটিত এই মর্মান্তিক মৃত্যুর বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। যা দেশে এবং বিদেশে ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আগুন লাগার বিষয়টি নাশকতা হতে পারে। তবে এত বিপুল মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য মালিকের অমার্জনীয় অবহেলাই দায়ী। এটি সুস্পষ্টভাবে অবহেলাজনিত মৃত্যু ঘটানোর অপরাধ। তাই তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেডের মালিককে দন্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় আইনের আওতায় এনে বিচারে সোপর্দ করার সুপারিশ করা হলো।’
মালিকের বিরুদ্ধে দুই মামলা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সুপারিশের পর মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা করা হয়। একটি মামলা দায়ের করেন একজন নিখোঁজ শ্রমিকের ভাই। আশুলিয়া থানার পুলিশ বাদী হয়ে অপর মামলাটি দায়ের করে। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর ৩২৩/৩২৫/৪৩৬/৩০৪/৩০৪-ক/৪২৭ দন্ডবিধিতে সিএমএম কোর্টে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সাক্ষী করা হয় ১০৪ জনকে। পরবর্তীকালে ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত মালিক মো. দেলোয়ার হোসেনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত হয় এবং সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয় ওই বছরের ১ অক্টোবর।
তিনি বলেন, ‘কোর্ট থেকে সমন জারি করা হলে সেটা পুলিশের মাধ্যমে হাজির করতে হয়। কিন্তু সেখান থেকে কিছু জানানো হয় না।’ এভাবে চলতে থাকলে যে কয়জন সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের ওপরে মামলা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব কিনা, প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সমন যাদের নামে যায় তাদের না পেলে, তারা মারা গেলে, সেই রিপোর্ট পুলিশকে পাঠাতে হবে। তা না- হলে সাক্ষীর অপেক্ষা করতে হবে।’
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম সবুজ মনে করেন, সাক্ষী হাজির না করে, মামলা পরিচালনায় দীর্ঘসূত্রতার পথ বেছে নেওয়াটা একটা কৌশল। সময় যত যাবে বিচারপ্রার্থী ও ভুক্তভোগী শ্রমিক পরিবারগুলো তত বেশি বিমুখ হয়ে উঠবে। তাজরীন অগ্নিকাণ্ডে নির্মমভাবে শ্রমিক হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই মামলাটিতে আমরা নজর রাখবো।’