রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা কলাবাগান। বহু সরকারি-বেসরকারি অফিস রয়েছে এই থানা এলাকাটিতে। বিশেষ করে এই এলাকার গ্রিন রোডের পুরোটা জুড়ে ডজনেরও বেশি নামীদামী হাসপাতাল রয়েছে। তবে এ থানায় কিছু হারানো সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ছাড়া মামলার সংখ্যা খুবই কম। চলতি মাসে মাত্র চারটি মামলা দায়ের হয়েছে। থানার কার্যক্রম প্রথমে ভাড়া করা একটি কমিউনিটি সেন্টারে শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে তা নিয়ে যাওয়া হয় ভাড়া করা একটি ফ্ল্যাট বাসায়। আর এই ফ্ল্যাট বাসায় থানার কার্যক্রম চালাতে পুলিশ কর্মকর্তাদের যেমন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, তেমনি অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে সেবা গ্রহীতাদেরও।
শুক্রবার (১৬ ডিসেম্বর) দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত সরেজমিনে থানায় অবস্থান করে দেখা যায়, শুধু দুইটি জিডি ছাড়া আর কেউ কোনও সেবা নিতে থানায় আসেননি।
পান্থপথ হয়ে বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের ঠিক উল্টোপাশে ডান পাশের গলি দিয়ে ১ মিনিট হাঁটলেই ৬ তলা বিশিষ্ট কলাবাগান থানা ভবন। ভাঙা রাস্তা সরু গলি দিয়ে থানায় ঢুকতেই প্রধান ফটকের সামনে চোখে পড়ে জব্দ করা কিছু মোটরবাইক। সরু রাস্তায় বৃষ্টি ছাড়াও সবসময় পানি জমে থাকে। প্রথম দেখায় বোঝার উপায় নেই এটা কোনও থানা। আবাসিক ভবনের এই বাসায় থানার কাজে ব্যবহৃত গাড়িগুলোর রাখার আলাদা কোনও জায়গাও নেই। সরু গলির দুই পাশেই সাড়ি করে রাখা আছে গাড়িগুলো। এতে যেমন পথচারীদের অসুবিধা হচ্ছে তেমনি অসুবিধা হচ্ছে থানায় আসা সেবা গ্রহীতা ও থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও।
থানাটি সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, আবাসিক হিসেবে এই ফ্লাটের ডাইনিং রুমে করা হয়েছে ডিউটি অফিসারদের বসার জায়গা। আর সেখানেই করা হয়েছে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা হাজত খানা। পুরো ফ্ল্যাটটিতে একটি মাত্র বাথরুম। পুলিশের নারী-পুরুষ সদস্যরা ওই একটি বাথরুমই ভাগাভাগি করে ব্যবহার করছেন। বাইরে থেকে থানায় সেবা নিতে আসা ব্যক্তিরাও ব্যবহার করেন ওই বাথরুমটি।
শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) বিকাল ৪টার দিকে এলাকার কিচেন রোডের বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন চৌধুরী এবং তার ছেলে রাজুন চৌধুরী একটি জিডি করতে থানায় আসেন। ছেলে রাজুন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আজ সকালে পুরান ঢাকার বাবু বাজার ব্রিজের কাছ থেকে আমার বাবার মোবাইল ফোন কে বা কারা নিয়ে যায়। এ বিষয়ে জিডি করতে আসলে প্রথমে ফোন খোয়া যাওয়া এলাকায় জিডি করতে বলা হয় থানা থেকে। পরে অবশ্যই উনারাই আমাদের জিডি নিয়েছেন। থানার সার্ভিস খারাপ না, ভালোই।
এলাকার হাতিরপুল মসজিদের পাশের একটি বাসায় আজ সকালে চুরি হয়। বাসার মালামাল চুরি হওয়ায় ভুক্তভোগী রোমান ও মিননাত আসেন কলাবাগান থানায় জিডি করতে। তাদের একজন রোমান বলেন, আমরা চুরির বিষয়ে জিডি করতে আসছিলাম। কোনও ঝামেলা হয়নি। আমরা তথ্য দিয়েছি উনারা নিজেরাই অনলাইনে আমাদের জিডি করতে সাহায্য করেছেন। তবে এখানে আসা এবং গাড়ি রাখার ভোগান্তি রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সুবিধার্থে ২০০৯ সালে ধানমন্ডি থানা ভেঙ্গে কলাবাগান থানা করা হয়। শুরু থেকে থানার নিজস্ব কোনও জায়গা না থাকায়, জরাজীর্ণ সিটি করপোরেশনের ধানমন্ডি ভূতের গলি কমিউনিটি সেন্টার থেকে চালানো হয় কার্যক্রম। দীর্ঘদিন ব্যবহারের পরে কমিউনিটি সেন্টারটি ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
পরে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসের ২ তারিখে থানার কার্যক্রম নতুনভাবে শুরু করে বসন্ধুরা সিটি শপিং মহলের উল্টোপাশে, হোটেল সুন্দরবনের পেছনে কাঠালবাগান এলাকায়। নিজস্ব থানা ভবন না হওয়া পর্যন্ত আব্দুল মোমেন গ্রুপ লিমিটেড এর ৬তলা বিশিষ্ট ভাড়া করা ভবনে কলাবাগান থানা অস্থায়ীভাবে তার সকল কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এর আগে কলাবাগান এলাকার তেঁতুলতলা মাঠে থানা স্থাপন করার চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসন ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট এক নোটিশে ডিএমপির কলাবাগান থানার নিজস্ব ভবন নির্মাণের জন্য এই সম্পত্তি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করে। তবে এলাকার শিশুদের খেলাধুলার একমাত্র জায়গা হওয়ায় জায়গাটি মাঠ হিসেবেই রাখতে প্রতিবাদ জানায় এলাকাবাসী।
থানাটি নিজস্ব ভবনে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. শহিদুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, থানাটির সকল কার্যক্রম ভাড়া করা জায়গায় পরিচালিত হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি থানার নিজস্ব জায়গায় ভবন তৈরির। তবে উপযুক্ত জায়গা এখনও কোথাও পাওয়া যায়নি। জায়গা পেলে আমরা নিজস্ব ভবন তৈরি করবো।
কলাবাগান থানার অফিসার ইনচার্জ মো. সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যেহেতু কলাবাগান থানায় স্বল্প আয়ের মানুষের সংখ্যা কম, বেশিরভাগই উচ্চবিত্ত। তাই ভৌগোলিক কারণে এ থানায় মামলা সংখ্যাও কম। সাধারণ ডায়েরি যেগুলো হয় অধিকাংশই জিনিসপত্র হারানো বিষয়ে। ছিনতাইও নেই খুব একটা, চলতি মাসে একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ছিল এবং গত মাসে একটি ছিল। গত পাঁচ মাসে এ থানা এলাকায় দুইটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া বড় ধরনেরও কোনও মামলা নেই, ক্রাইম নেই বললেই চলে। চলতি মাসে আজ ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মামলা হয়েছে মাত্র চারটি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো থানা ভবন। আমরা ভাড়া ফ্ল্যাট বাসায় অফিস করি। ৩ লাখ টাকার উপরে ভবনটির মাসে ভাড়া দিতে হয়। আমাদের থানায় মোট ১০০ জনের মতো পুলিশ অফিসার, নারী-পুরুষ পুলিশ সদস্য রয়েছে। তাদের চলাচলে কষ্ট হয়। থানায় সেবা গ্রহীতাদেরও প্রবেশ করতে অসুবিধা হয়।
ভবনটির দ্বিতীয় তলায় এক পাশে অফিসার ইনচার্জ ওসির রুম আরেক পাশে ডিউটি অফিসারদের রুম। ডিউটি অফিসার রুমের পাশেই নারী-পুরুষ উভয়ের হাজতখানা। জায়গার সংকটে গাদাগাদি করে বসতে হচ্ছে অফিসারদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যারা এখানে সেবা নিতে আসেন তাদের অনেকটা কষ্ট করতে হয়। থানাটি আবাসিক এলাকার ভেতরে, আর সরু গলি হওয়ায় সহজে থানার ঠিকানাও খুঁজে পাওয়া যায় না। দেখা যায়, অনেকেই থানায় আসার আগে আমাদের জরুরি নম্বরে ফোন করে ঠিকানা জানতে চান।
অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের একটা বড় সমস্যা হলো খাবারের। রাজধানীর অনেক থানায় পুলিশের জন্য ক্যান্টিন থাকলেও আমাদের থানায় খাবারের কোনও ব্যবস্থা নেই। ফলে আমরা যারা ছোট পোস্টে আছি তাদের খাবারের জন্য কষ্ট করতে হয়, ফুটপাতের হোটেলে খেতে হয়। এতে টাকা যেমন বেশি খরচ হয়, আবার শরীরও খারাপ হয়।’