গণজাগরণ মঞ্চের ১০ বছর

এখনও আক্রমণের শিকার হন সেই স্লোগানকন্যা

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ২৭-এর ৪ ধারা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এ সময় স্লোগান দেওয়ার মতো আর কেউ ছিল না। ঠিক তখনই গর্জে ওঠে তেজোদীপ্ত এক বজ্রকণ্ঠ। শ্যামলা রঙের দুরন্ত এক তরুণী। নাম লাকী আক্তার। তখন তিনি ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অষ্টম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ও ছাত্র ইউনিয়ন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক।

সেদিন মুষ্টিবদ্ধ মাইক্রোফোনে স্লোগানের মাধ্যমে সবাইকে আলোড়িত করেন লাকী। তার ছন্দবদ্ধ স্লোগানে উপস্থিত সবাইকে বিমোহিত করে ফেলেন। তার স্লোগানের উদ্দীপনা জাগিয়ে রাখে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দাবিতে শাহবাগের ‘গণজাগরণ’ বা ‘প্রজন্ম চত্বর’। তার তেজোদ্দীপ্ত স্লোগান তাকে পরিচিত করে দেয় পুরো বিশ্বের সঙ্গে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তার স্লোগানের সেই চিত্র প্রচার করা হয়। তিনি উপাধি পান ‘স্লোগান কন্যা’ হিসেবে।

কিন্তু এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে একশ্রেণির লোক ভিন্ন খেলায় মেতে ওঠে। আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার চালায় তারা। লাকীকে নিয়ে ট্রল করা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বর্তমানে তিনি পুরোদস্তুর রাজনীতি সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ কৃষক সমিতির নির্বাহী সদস্য এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে সক্রিয় রয়েছেন তিনি।

শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লাকী জানান, আজও তাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্রমণ করা হয়। এমনি তার ছোট মেয়েটাকেও বাদ দেওয়া হয় না আক্রমণ থেকে।

গণজাগরণ মঞ্চের দিনগুলো নিয়ে স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘গণজাগরণ আন্দোলন বাংলাদেশে একটি অভূতপূর্ব আন্দোলন ছিল। বাংলাদেশ জন্মের পর থেকেই এত বড় মুভমেন্ট কখনোই দেখে নাই। লাখ লাখ মানুষ সমবেত হয়েছে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ অংশগ্রহণ করেছে। ঐতিহাসিক যে দায়, সেই দায় থেকে আমরাও সমবেত হয়েছিলাম। বিশেষ করে বাচ্চু রাজাকারের পলাতক হয়ে যাওয়া আমাদের অনেক বেশি ক্ষুব্ধ করেছিল।’

‘এ ছাড়া কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ায় শুধু আমিই না, সারা দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছিল। বাংলাদেশের যে আইন, সে আইনের আলোকে সে সর্বোচ্চ শাস্তি পায়নি।  ফলে সে ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়েছিল। এটি আমাদের দেশের মানুষকে ব্যাথিত করেছিল, ক্ষুব্ধ করেছিল এবং তারা রাস্তায় নেমে স্লোগান দিয়েছিল, ‘আপসের এই রায় মানি না’।’

‘আমরাও রাস্তায় নেমেছিলাম। শুরুটা হয়েছিল হয়তো খুব ছোট পরিসরে। দুপুর বেলা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী মিছিল করে শাহবাগে অবস্থান নেন। পরে সন্ধ্যার মশাল মিছিল এসে একত্র হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণজাগরণ মঞ্চ অনেক বড় চাপ রেখে গেছে এবং গণজাগরণ মঞ্চের কাছে আমাদের বারবার ফিরে আসতে হবে। কারণ এটা আর কিছু না, আসলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে ছিলাম।’

এই আন্দোলনের পর নারীদের প্রচণ্ড আক্রোশের শিকার হতে হয়েছিল বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন,‘এই আন্দোলনের বাতিঘর ও প্রধান প্রেরণা হিসেবে ছিলেন জাহানারা ইমাম। এই আন্দোলনে নারীদের যেই অভুতপূর্ব অবস্থান, ফলে পরবর্তীতে প্রচণ্ড আক্রোশের শিকার নারীদের হতে হয়েছিল।’

নিজ সন্তান সম্পর্কে বাজে কথা দেখতে-শুনতে হয় জানিয়ে লাকী বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাকে গণজাগরণ মঞ্চের স্মৃতি বহন করে যেতে হয়। এখন পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে সব জায়গায় আমাকে আক্রান্ত হতে হয়, আমার একটি মেয়ে হয়েছে, তাকেও আক্রান্ত হতে হয়। কোনও একটি পোস্ট দিলে তারা (অপপ্রচারকারীরা) এসে প্রোপাগান্ডা ছড়ায়, আক্রমণাত্মক মন্তব্য করে।’