ইসলামপুরে বাড়তি দামে পুরনো ডিজাইনের পোশাক

পুরান ঢাকার ইসলামপুর দেশের বৃহত্তম পাইকারি কাপড় বিক্রির বাজার। দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের শাড়ি,পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, থ্রি পিস, বোরকা থেকে শুরু করে সব ধরণের পোশাক পাইকারি দামে বিক্রি হয় এই বাজারে। প্রতি বছর ঈদকে কেন্দ্র করে এ সময় ইসলামপুর জমজমাট থাকলেও এবার তার ব্যতিক্রম। তাছাড়া নতুন বাহারি ডিজাইনের পোশাকও দৃশ্যমান নয়। এবার পোশাকের মান নিয়ে অভিযোগ না থাকলেও দাম নিয়ে অভিযোগ আছে ক্রেতাদের। এমনকী গত বছরের পোশাক এ বছর বাড়তি দামে বিক্রির অভিযোগও করছেন ক্রেতারা।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতি বছর বাহারি রকমের পোশাকে ইসলামপুর জমজমাট থাকলেও এবার সেই বাহারি পোশাক নেই। নতুন কোনও ডিজাইনের পোশাক চোখে পড়েনি বললেই চলে। নারীদের মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু শাড়ি এবং থ্রি পিসেও পুরনো ডিজাইন।

নতুন ডিজাইনের পোশাক না পেয়ে আরিশা আরাফ নামের এক ক্রেতা হতাশ হয়ে বলেন, ইসলামপুরে সব সময় ঈদের আগে নতুন ডিজাইনের পোশাক পাওয়া যায়। এবার পুরো ইসলামপুর ঘুরে দেখলাম কিন্তু নতুন কোনও কালেকশন দেখিনি। সব কিছুই পুরনো ডিজাইনের। দোকানদাররা বলছে পুরনো মাল শেষ না হলে নতুন মাল কীভাবে আনবে!

ইসলামপুরে কাপড় কিনতে আসা লোভা নামের আরেক ক্রেতা জানান, এখানে অন্যান্য জায়গার চেয়ে কম দামে নতুন ডিজাইনের জামা কাপড় পাওয়া যায়। এ জন্য প্রতি বছর আসি। এবার থ্রি পিস, শাড়ি কোনও কিছুই নতুন ডিজাইনের নেই। শাড়িতে কিছুটা নতুনত্ব আসলেও থ্রি পিস বেশিরভাগ আগের ডিজাইনের। তাছাড়া আগের চেয়ে তুলনামূলক দাও বেশি।

ইসলামপুরের-কাপড়ের-মার্কেট-02

দাম কেন বেশি জানতে চাইলে বললেন, বিক্রেতাদের কত বাহানা। ডলার সংকটের কারণে পোশাকে বাড়তি খরচ যোগ হয়েছে। এই জন্য গত বছরের চেয়ে এবার পোশাকের দাম বেশি। ভোক্তা অধিকার থেকে একটু যাচাই-বাছাই করলে আসল রহস্য বের হতো। আসলেই কি খরচ বেড়েছে, এই কারণে দাম বেড়েছে নাকি তারা ইচ্ছে করেই দাম বাড়াচ্ছে।

পটুয়াখালী থেকে ইসলামপুরে পাইকারি দামে থ্রিপিস আর গজ কাপড় কিনতে এসেছেন আবু মুসা। তিনি জানান, রোজার একদিন আগেও যে কাপড়ের গজ ছিল ৬০ টাকা তা এখন ৬৬ টাকা। গজ প্রতি ৬ টাকা দাম বেড়েছে। থ্রিপিসেও পাইকারি দর ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে গেছে। লুঙ্গির দাম সবচেয়ে বেশি। আমানত শাহ, স্ট্যান্ডার্ড এগুলো গত বছরের তুলনায় ৪০ টাকা বেশি। গতবার একসঙ্গে যে মাল কিনছি দেড় লাখ টাকা দিয়ে এবার তা ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। কোনও একটা বাহানা পেলেই শুধু মানুষ দাম বাড়ায়। আমরা তো এখান থেকে পাইকারি কিনে নিয়ে যাই। পাইকারি যদি দাম বেড়ে যায় তাহলে খুচরা বিক্রিতে তো অটোমেটিক দাম বাড়ে।

এদিকে কাপড়ের দাম তুলনামূলক বাড়ার কথা স্বীকার করে বিবেক ওয়ার্ল্ড এর বিক্রেতা রাফিন বলেন, আমরা পাইকারি বিক্রেতা। আমাদের পাইকারি কাস্টমার ধরে রাখার জন্য দাম বাড়া সত্ত্বেও আগের দামেই মাল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। আমরা যদি দাম বাড়াই তাহলে পাইকারি ক্রেতা হারাবো। এ জন্য কম লাভ হওয়া সত্ত্বেও আগের দামেই মাল বিক্রি করছি। নতুন ডিজাইন, প্রোডাক্ট এবার সাপ্লাই দেয় নাই কেউ। তবে আরও দুই এক দিন পর হয়তো আসতে পারে। এখন আগের যা আছে তাই বিক্রি করতেছি। আগের মাল শেষ না হলে তো নতুন মাল আনতে পারবো না। তবে বেচাকেনা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। এবার ঈদ ও পহেলা বৈশাখ কাছাকাছি হওয়ায় বাড়তি বিক্রির আশা করছি।

ইসলামপুরের-কাপড়ের-মার্কেট-03

রিয়া ফ্যাশন হাউজের প্রোপাইটর শাহরিয়ার আলম জানান, ব্যবসা আগের মতোই আছে। লাভ খুবই সীমিত। এখন শুধু আগের কাস্টমার ধরে রাখার চেষ্টা। বঙ্গবাজারে আগুন লাগার কারণে পোশাকের দাম বাড়বে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মানুষের পোশাকের চাহিদা যদি পূরণ না হয় অর্থাৎ বাজারে যদি পোশাকের ঘাটতি দেখা দেয় তাহলে হয়তো কিছুটা দাম বাড়বে। এমনিতে বাড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। যারা বঙ্গবাজারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দাম বাড়াবে, তারা অসাধু ব্যবসায়ী। তাছাড়া আমরা পাইকারি বিক্রেতা, তারা খুচরা বিক্রেতা। তবে এ নিয়ে ইসলামপুরের দাম বাড়ার সম্ভাবনা আদৌ নেই।

আলমগীর হোসেন নামের ইসলামপুরের আরেক ব্যবসায়ীর ভাষ্য, বড় দোকানগুলোতে ব্যবসা আগের মতোই জমজমাট। ছোট দোকানগুলোতে এখনও বেচাকেনার তেমন চাপ পড়েনি। আশা করি পনের রমজানের পর পড়বে। আমরা তো পাইকারি বিক্রি করি। তবে এখন পাইকারি বিক্রির চাপ না থাকায় মাঝেমধ্যে খুচরাও বিক্রি করছি। এবার পাইকারি বাজার কিছুটা স্থিতিশীল। দাম ওতো বেশি বাড়েনি। তবে তুলনামূলক বিক্রি কমেছে। মানুষের চাহিদাও আগের তুলনায় কমেছে। আগে যে দুই লট মাল নিতো সে এখন তার অর্ধেক নিচ্ছে।

পাইকারি পাঞ্জাবির কাপড় ব্যবসায়ী মাহফুজুর রহমান আক্ষেপ জানিয়ে বলেন, আমরা যারা নতুন কাপড় ব্যবসায়ী আছি তাদের জন্য ব‌্যবসা করাটা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। মানুষ ঠিক মতো খাইতে পারে না, নতুন পোশাক কী কিনবে বলেন। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে, কাস্টমার আসছে, দেখছে, চলে যাচ্ছে। যেখানে কম দামে পাচ্ছে সেখান থেকে কিনছে। এখন যারা ব্যবসায় কয়েক কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছে তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা এর ফাঁকে অল্প স্বল্প যা আয় করতে পারছি। অনেকে বলছে থান কাপড়ের দাম বাড়ছে। এটা তো আমরা বাড়াইনি। আমরা যাদের কাছ থেকে লটে মাল কিনে আনি তারা বাড়াইছে।

ইসলামপুরের-কাপড়ের-মার্কেট-04

অন্যদিকে বেচাকেনা কম হওয়ায় অলস সময় পার করছেন ইসলামপুরের দিনমজুররা। জামাল মিয়া নামের এক শ্রমিক জানান, বেচাকেনা বেশি হলে আমরা একটু বেশি কাজ করতে পারি। ইনকামও ভালো হয়। মানুষ বেশি করে কিনলে আমরা তা মাথায় করে গাড়িতে তুলে দেই। তখন কাপড় অনুযায়ী আমাদেরকে একটা সম্মানী দিয়ে দেয়। এখন বেশিরভাগ মানুষ হাতে করেই কাপড় নিয়ে যায়। আমাদের আর দরকার হয় না। রোজার দিনে দৈনিক ৩০০ টাকা কামাই করা যায় না। আগে তো দৈনিক ৫০০-৬০০ টাকা কামাই করা যাইতো। আশায় আছি যেন ভালো বেচাকেনা হয়। তাহলে আমাদের মজুরি বাড়বে, ইনকামও ভালো হবে।