লালখাতায় হালখাতা

বাংলা নববর্ষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে হালখাতার সংস্কৃতি। আর হালখাতার অন্যতম অনুষঙ্গ লালখাতা। সময়ের সাথে জৌলুস হারাচ্ছে হালখাতা, গুরুত্ব কমছে লালখাতারও।

বাঙালির হালখাতা সংস্কৃতি হলো বাংলা সনের প্রথম দিন। হালখাতা হলো দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা খদ্দেরদের সাথে বিগত বছরের খাতায় তাদের দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে  এ দিন হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এ উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের মিষ্টিমুখ করান, খদ্দেররাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুরোনো দেনা শোধ করেন। আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এ খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে হালনাগাদ করা হতো। হিসাবের খাতা হালনাগাদ করা থেকে ‘হালখাতা’র উদ্ভব।IMG_2874

বাঁধাইশ্রমিকরা লম্বা সাদা কাগজ বাঁধাই করে লাল সালু কাপড়ের মলাটে মুড়িয়ে মোটা লালখাতা তৈরি করেন। হিসাবের এই খাতার প্রতি পাতায় চারটি করে সমান ভাঁজ থাকে। বাম পাশে জমা ও ডান পাশে খরচের হিসাব। লালখাতাকে টালিখাতা নামেও ডাকা হয়।

বাংলা নববর্ষ ১৪৩০ উপলক্ষে তাই লালখাতা তৈরির ব্যস্ততা বাঁধাই কারখানাগুলোতে। পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজার, জিন্দাবাজার ও বাবু বাজারে ঘুরে দেখা যায়, বাঁধাইশ্রমিকরা টালিখাতা বাঁধাই নিয়ে ব্যস্ত। বৈশাখের শুরুতেই পুরান ঢাকার এ জায়গাগুলোতে টালিখাতা তৈরির ধুম পড়ে।

ব্যবসায়ী ও বাঁধাইকারখানা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সময়ের সাথে চাহিদা কমছে লালখাতার। মূলত হালখাতার সংস্কৃতি কমে যাওয়ায় লালখাতার কদরও কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা সারাবছর ধরে হালখাতা করায় এখন সারাবছরই লালখাতা কেনাবেচা হয়। এছাড়াও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কমেছে লালখাতার ব্যবহার। বিশেষ করে বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোতে লালখাতার জায়গা নিয়েছে কম্পিউটার, স্মার্টফোন।

সাইদ প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী হাসানুজ্জামান বলেন,  '৫-৬ বছর আগেও  বৈশাখের এক থেকে দুই মাস আগে ৫০০ থেকে ৬০০ পিস খাতা অর্ডার পেতাম।  হালখাতা উৎসবের আমেজটা এখন অনেক কম বললেই চলে। যার ফলে টালিখাতার চাহিদাও আর তেমন নেই। এছাড়াও এখন সবাই হিসাব রাখতে আর লালখাতা ব্যবহার করে না।'

পুরান ঢাকা এলাকায় ৩০ বছর ধরে ফেরি করে টালিখাতা বিক্রি করেন করিম মিয়া। তিনি বলেন, ‘প্রায় ৩০ বছর ধরে ফেরি করে এখানে টালিখাতা বিক্রি করি। একটা সময় বৈশাখের আগেই ব্যবসায়ীরা আমাকে বলে রাখতেন খাতার জন্য। এখন আর সেই বিক্রি নেই।’IMG20230409165343

নয়াবাজার এলাকার হাসান আকরাম হাউজের স্বত্বাধিকারী কামরুজ্জামান বলেন, ‘দশ বছর আগেও আমরা বৈশাখের আগে রাত-দিন লালখাতা বানাতাম। ঢাকার বাইরেও খাতা পাঠাতাম। এখন আর সেই অবস্থা নেই। কম্পিউটারের যুগ এখন, ফোনেই টালিখাতা থাকে। আমি নিজেই ফোনে টালিখাতা ব্যবহার করি।’

লালখাতা বা টালিখাতা ছোট, বড়, মাঝারি কয়েক প্রকার হয়ে থাকে। টালিখাতার মলাটের ডিজাইন ও দিস্তা প্রতি দাম নির্ধারণ হয়। এক থেকে আট দিস্তা পর্যন্ত টালিখাতা হয়ে থাকে। পাইকারি বাজারে টালিখাতার দাম দিস্তা প্রতি ৮০ টাকা আর খুচরা বাজারে দাম পড়ে ১০০-১২০ টাকা।

শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী সানাউল্লাহ ভূইয়া বলেন, ‘এবছর হালখাতা বছরের মাঝামাঝি করবো। আর এখন তো লালখাতা সারাবছরই লাগে। তাই বৈশাখের আগে লালখাতা কেনা হয় না। এখন মানুষ টাকা দিয়ে দেয়, মোবাইলের যুগ। তাই হালখাতার তেমন আনুষ্ঠানিকতা হয় না আগের মতো।’IMG_2869

শাঁখারীবাজারের লক্ষ্মী জুয়েলার্সের সত্ত্বাধিকারী প্রবল রায় বলেন, ‘পহেলা বৈশাখের দিন গণেশ ঠাকুরের নামে পূজা করা এবং লালখাতার মধ্যে সিঁদুরের ফোঁটায় এক টাকার কয়েনের ছাপ দিয়ে নতুন হিসাব খোলা হয়। ছোটোবেলায় বাবা করতেন, এখন আমিও করি। এবারও পহেলা বৈশাখে হালখাতা করছি, নতুন লালখাতাও কিনেছি।’