সবুজে বদলে যাওয়া ‘মরুভূমির শহর’

যে এলাকার প্রচণ্ড খরা ও তীব্র গরমে একসময় লেখা হয়েছিল ‘খরদাহ’ উপন্যাস, সে শহর এখন সবুজের নগরীর খ্যাতি পেয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী নগরীর ফুটপাত, রাস্তার ডিভাইডার, বাসার আঙিনা, স্কুলের মাঠ ভরে উঠেছে সবুজে। কেবল সবুজ না, দেশের বিলুপ্ত প্রায় বেশ কয়েকটি গাছে ভরিয়ে ফেলা হয়েছে নগরী। তারই একটা ছাতিম। নগরে যখন হাতে গোনা ছাতিম গাছ খুঁজে বের করতে হয়— তখন রাজশাহী শহরের ফুটপাতজুড়ে শত শত ছাতিমে ভরিয়ে ফেলা হয়েছে। তীব্র গরমের দুপুরে মাথার ওপর রোদ যখন ক্লান্ত করে দেয়, তখন শ্রমিকশ্রেণী এরই ছায়ায় বিশ্রাম নেন।udi3

২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত খায়রুজ্জামান লিটন প্রথমবার মেয়র থাকাকালে রাজশাহী শহরকে সবুজের মহানগরীতে রূপ দিতে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে ‘জিরো সয়েল প্রকল্প’ নামে সবুজায়ন প্রকল্প নেয় রাজশাহী সিটি করপোরেশন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর থেকে নগরবাসীর নজর কাড়ে— রাস্তার ডিভাইডারে (বিভাজকে) সূর্যমুখী, রঙন, কাঠ গোলাপ থেকে শুরু করে বড় বড় পাম গাছে ভরে গেছে পুরো নগরী। কীভাবে সম্ভব হলো— প্রশ্নে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, গত চার বছরে রাসিকের উদ্যোগে এক লাখ ৬১ হাজার ৬১৬টি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ মহানগরের বিভিন্ন স্থানে, সড়ক বিভাজক, সড়ক দ্বীপে রোপণ করা হয়েছে। লক্ষাধিক হেজ জাতীয় গাছ রাস্তার আইল্যান্ড ও শহরের ফাঁকা জায়গায় লাগানো হয়েছে। শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান বোটানিক্যাল গার্ডেন ও চিড়িয়াখানায় লাগানো হয়েছে বিভিন্ন দুর্লভ প্রজাতির গাছ। গাছগুলো হচ্ছে— বৈলাম, তেলসুর, ধারমারা, উদাল, ঢাকিজাম, তিতপাই, গুটগুটিয়া, হলদু, বাটনা, গর্জন, বনজলপাই, ছাতিয়া, শ্বেত চন্দন ও আগর।

সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের একেকটি রাস্তায় একেক ধরনের গাছ শোভা পাচ্ছে।

ফুটপাতে ব্লক বসানো হলেও পরিকল্পনা করে গাছের জন্য আলাদা জায়গা করে পাঁচশ’ গজ পরপরই লাগানো হয়েছে ছাতিম। পুরো নগরের রোড ডিভাইডারগুলোতে ছোট-বড় নানা জাতের ফুলের গাছ, ঝোপের চেয়ে গাছের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে বেশি। সেটা নগরবাসীর বিশ্রাম নেওয়া থেকে শুরু করে নানা কাজে আসবে। ৩৭ ডিগ্রি তাপমাত্রায় গনগনে দুপুরে ছাতিম গাছের নিচে বিশ্রামরত ভ্যানচালক মোখলেস বলেন, ‘আগে পামগাছগুলো ডিভাইডারের ভেতরে ছিল, আমাদেরকে রাস্তার মাঝখানে গিয়ে কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিতে হতো। এখন ফুটপাতেই ছায়াময় এই গাছ হওয়ায় বেশ আরাম হয়েছে। এই গাছের স্থানীয় নাম ছেইতেমা থেকে শুরু করে আরও অনেক রকমের আছে। তবে ছোট থাকা অবস্থাতেই যে ছায়া দেয়, অন্য অনেক গাছ সেটা দেয় না।’

346104463_1340435116823337_5582358302057613254_nরাজশাহীর সবুজের কথা উঠলেই মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের (আগামী নির্বাচনের জন্য বিধি অনুযায়ী ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন) পাশাপাশি রাসিকের পরিবেশ শাখার কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদ-উল-ইসলামের নাম উচ্চারিত হয়। কেন এত ছাতিম গাছ লাগানো হলো প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ছাতিম গাছে সেপ্টেম্বরের দিকে ফুল আসে। সেই ফুলে একটা অদ্ভুত সুঘ্রাণ হয়। এই গাছের একটা চমৎকার আকার আছে, অনেক বেশি এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে হয় এমন না, কিন্তু উঁচু হয়, সেটা ফুটপাতে ব্যবহারের উপযোগী। আর এ ধরনের বিলুপ্তপ্রায় আরও কয়েক প্রজাতির গাছ আমরা সিটি করপোরেশন এলাকায় লাগাতে চেয়েছি। মেয়র মহোদয়ের পরামর্শে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা গাছও এখানে লাগানো হয়েছে। সূর্যমুখীর যে পরিমাণ বীজ আমরা সংরক্ষণ করেছি, আগামী বছর পুরো শহরে সূর্যমুখী ফুলে ছেয়ে দেওয়া যাবে।’

সৈয়দ মাহমুদ-উল-ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা শহরে যে নাগালিঙ্গম গাছ খুঁজে বেড়াতে হয়, আমাদের রাজশাহীতে ৫টি নাগালিঙ্গম আছে। আমরা সেটিরও বীজ সংরক্ষণের যাবতীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। যে গাছগুলো আছে সেগুলো যেন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটিও তদারকি করা হয়।’udi2

ছাতিম গাছটি ভীষণ সৌন্দর্যবর্ধক উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সুজা উদ-দৌলা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এর ভেষজ গুণ আছে ঠিকই, কিন্তু রাজশাহীতে যে বিপুল সংখ্যক লাগানো হয়েছে, সেটা সৌন্দর্যের কথা ভেবেই করা। এটি আমাদের দেশি গাছ, দেখতে অনেকটা বনসাঁইয়ের মতো। এর ফুল ভীষণ সুন্দর ও সুগন্ধি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি গাছই তার ফুল ও গন্ধ দিয়ে প্রকৃতির বিভিন্ন পোকামাকড়কে আকৃষ্ট করে। সেসব বিবেচনায় রেখে নগরে গাছ লাগালে নগরবাসী সুফল পাবে।’