মালয়েশিয়ায় গিয়ে জিম্মি কয়েকশ বাংলাদেশি কর্মী

মাগুরার আড়পাড়া গ্রামের বাসিন্দা হাসিবুর রহমান (ছদ্মনাম)। পরিবারের আয়-উন্নতি বাড়াতে ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া যান তিনি। সেদেশে গিয়ে প্রতি মাসে ১৫শ রিঙ্গিত (যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩০ হাজার) আয় করার কথা ছিল তার। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে হাসিবুরের এই স্বপ্ন এখন যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। চাকরি করার বদলে মালয়েশিয়ার ‘সুরিয়া হারমোনি’ নামে একটি কোম্পানির লোকজনের হাতে জিম্মি হয়ে আছেন তিনি। শুধু হাসিবুর একা নয়, তার মতো আরও অন্তত ৪০০ বাংলাদেশি শ্রমিক এই কোম্পানির লোকদের হাতে জিম্মি হয়ে আছেন।

ভুক্তভোগী কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসিবুরসহ ১৪ জনের একটি দল গত ২৫ আগস্ট রিক্রুটিং এজেন্সি এশিয়াটিক ট্যালেন্টসের মাধ্যমে ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর গিয়ে পৌঁছায়। নির্মাণ খাতে কাজ করানোর কথা বলে তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর বুঝতে পারেন যে, আসলে কাজের জন্য নয়, আরও টাকা আদায় করার জন্য তাদের সেদেশে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই চক্রের চাহিদা মতো টাকা পরিশোধের পরও কাজের নিশ্চয়তা মিলবে কিনা, তা জানা নেই হাসিবুরসহ কারোই।

হাসিবুর জানান, মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর তাদের কাছ থেকে কোম্পানির প্রতিনিধিরা সবার পাসপোর্ট নিয়ে গেছে। এরপর কোম্পানির পক্ষ থেকে তাদের বলা হয়— মালয়েশিয়ান ছয় হাজার রিঙ্গিত পরিশোধ করে পাসপোর্ট ফেরত নিতে হবে। এর আগেও এখানে আরও অনেক বাংলাদেশিকে এভাবে জিম্মি করা হয়েছে বলে জানান তিনি। জিম্মিদের অনেকে টাকা পরিশোধ করে পাসপোর্ট ফেরত পেয়েছেন। অনেকে আবার পালিয়ে গেছেন।

হাসিবুর বলেন, ‘জমি বন্ধক রেখে, এনজিও থেকে লোন নিয়ে, গরু বিক্রি করে ও আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করে মালয়েশিয়া আসার টাকা জোগাড় করেছি। বাড়ি থেকে এখন আর টাকা আনার মতো অবস্থা নেই। এখন কী করবো, কার কাছে যাবো, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। পুরোটাই অন্ধকারের মধ্যে আছি। কোম্পানির কথিত প্রতিনিধিদের চাহিদা মতো টাকা দিতে না পারলে পাসপোর্ট ও ভিসা পাবো না। পুরোপুরি অবৈধ হয়ে যাবো।’

একই দলের আরেকজন আকতার (ছদ্মনাম)। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি থানার বাসিন্দা। অন্য সব কর্মীর মতো তিনিও সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ করে কাজের আসায় মালয়েশিয়া যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে এখন জিম্মি জীবন কাটছে তার।

আকতার জানান, ‘আমাদের বলা হয়েছিল,  এখানে এসে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করবো। সে জন্য আমাদের দুই দিনের প্রশিক্ষণও করানো হয়। কিন্তু এখন শুনি, এ কোম্পানির নির্মাণ বিষয়ক কোনও কাজই নেই। এরা লোকদের এনে জিম্মি করে রাখে। তারপর মুক্তিপণ হিসেবে বড় অঙ্কের টাকা আদায় করে ছেড়ে দেয়। আমাদেরও জিম্মি করে রেখেছে। কখনও একবেলা খাবার দেয়, আবার কখনও তাও দেয় না। অনেক বড় বিপদের মধ্যে আমাদের জীবন কাটছে।

শুধু জিম্মি নয়, এখানে অবস্থানকারী কর্মীরা মাঝে-মধ্যে নির্যাতনের শিকার হন বলে জানান আকতার। তিনি বলেন, ‘এখানে এক ফ্লোরের জিম্মিদের সঙ্গে আরেক ফ্লোরের জিম্মিদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। কথা বলতে দেখলেই কোম্পানির লোকেরা মারধর করে। ভিসা-পাসপোর্ট ফেরত দেবে না বলে হুমকি-ধমকি দেয়। এছাড়া যখনই দেশের বাড়িতে স্বজনদের এ অবস্থার কথা জানিয়েছি, তখনই কোম্পানির লোকেরা এসে রুমের ভেতর আটকিয়ে মারধর করেছে। গায়ে গরম পানি ঢেলে দিয়েছে। গত শুক্রবার (২০ অক্টোবর)  দুজনকে রুমে আটকিয়ে মারধর করেছে। ভিসা ও পাসাপোর্ট ফেরত না দেওয়ার হুমকি দিয়েছে।’

ভুক্তভোগীরা জানান, তাদেরকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের চৌকিত এলাকার পুরনো সংসদ ভবনের সামনের একটি হোটেলে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। ওই হোটেলটি ‘সাদ্দাম হোটেল’ নামে পরিচিত। ‘সুরিয়া হারমোনি’ নামের কোম্পানিতে যারাই কাজ করতে আসেন, তাদের সবাইকে এখানে এনে জিম্মি করে রাখা হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এলাকার বাসিন্দা কিবরিয়া (ছদ্মনাম) চলতি বছরের ২৬ মে একই রিক্রুটিং এজেন্সি এশিয়াটিক ট্যালেন্টসের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গিয়ে পৌঁছান। তারপর থেকেই তিনি সেখানে জিম্মি অবস্থায় রয়েছেন।

তিনি জানান, আমি ৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় এসেছি। আমাকেও বলা হয়েছিল,  নির্মাণ শ্রমিকের কাজ পাবো। আসার পর প্রথম মাসে যখনই কাজের কথা বলতাম, তখন কোম্পানির লোকেরা বলতো— সময় হলেই কাজ পাবা। এভাবে এক মাস যাওয়ার পর আমার কাছ থেকে পাসপোর্ট আর ভিসা নিয়ে নেয়। এরপর আমার কাছে ৬ হাজার রিঙ্গিত চায় এবং বলে, এটা না দিলে পাসপোর্ট ও ভিসা দেবে না। আমার ফ্লোরের কয়েকজন জুলাই মাসে টাকা পরিশোধ করে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে বের হয়ে গেছে। আমার এখনও টাকা জোগাড় হয়নি, তাই দিতে পারছি না। জানি না, কবে টাকা পরিশোধ করে এই জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবো।

মালয়েশিয়া গিয়ে জিম্মি হওয়া কর্মীদের পাঠানো রিক্রুটিং এজেন্সি এশিয়াটিক ট্যালেন্টসের ব্যবস্থাপনা সহকারী মোহাম্মদ সাহিনুজ্জামানের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোইল ফোনে কল দেওয়া হলে প্রতিবারই কল কেটে দেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত আমরা কিছুই জানি না। আপনার থেকেই প্রথম জানতে পারলাম। আমরা খোঁজ নেবো।