ড্রাইভিং লাইসেন্স: এবার আরেকটু স্মার্ট হই!

২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি। রাজধানীর জোয়ারসাহারা এলাকায় লোকে লোকারণ্য। কোনও রাজনৈতিক দলের জনসভার প্রস্তুতি মনে হতে পারে। আসলে এখানে ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষা দিতে জড়ো হয়েছেন আগতরা। ছোট একটা মাঠ, সেখানে দুটো মেয়াদোত্তীর্ণ প্রাইভেট কার। দিনে কয়েকশ’ লাইসেন্স প্রত্যাশী এই গাড়িতে ওঠেন আর নামেন। রোড সেফটি নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, যে প্রক্রিয়ায় লাইসেন্স দেওয়া হয়—তাতে দক্ষ চালক পাওয়া কঠিন। এবং যেকোনও প্রকারে লাইসেন্স পাওয়ায় এমন সব দুর্ঘটনা ঘটে, যা হয়তো দক্ষ চালক এড়াতে পারতেন। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকই আছে।

২০২৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদের ২৪তম ও একই বছরের চতুর্থ অধিবেশনের প্রশ্নোত্তর পর্বে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এম. আব্দুল লতিফের এক প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, দেশে এখন পর্যন্ত ৫৯ লাখ ৪৬ হাজার ৫২৩টি ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা ৫৭ লাখ ৫২ হাজার ১৯৭টি। অনিবন্ধিত মোটরযানের বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ৬২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৯০২ জন নিহত, ১০ হাজার ৩৭২ জন আহত হয়েছেন। একই সময় রেলপথে ৫২০টি দুর্ঘটনায় ৫১২ জন নিহত ও ৪৭৫ জন আহত হয়েছেন। সংঘটিত দুর্ঘটনায় মোট ৮ হাজার ৫৫০টি যানবাহনের পরিচয় মিলেছে। এর মধ্যে ১৬.১৫ শতাংশ বাস, ২৪.৮৪ শতাংশ ট্রাক-পিকাপ-কাভার্ডভ্যান ও লরি, ৫.৯১ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস, ৫.৩৯ শতাংশ সিএনজি-চালিত অটোরিকশা, ২৬.০২ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৪.৪৭ শতাংশ ব্যাটারি-চালিত রিকশা ও ইজিবাইক, ৭.১৯ শতাংশ নছিমন-করিমন-মাহিন্দ্রা-ট্রাক্টর ও লেগুনা।

ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষা দিতে জড়ো হয়েছেন আগতরা

বিশ্লেষকরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর প্রথম উদ্যোগ হতে পারে চালকদের লাইসেন্স প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার মধ্য দিয়ে। বিদেশে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেওয়ার প্রক্রিয়া বলতে গিয়ে প্রবাসী জিয়াউল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিদেশে প্রশিক্ষণের পর পরীক্ষা দেওয়ার তারিখ ও স্থান জানানো হয়। সেখানে নির্দিষ্ট সময়ে গেলে গাড়ি প্রস্তুত থাকে। একটা গাড়িতে ওঠার পর পাশের সিটে একজন পরীক্ষক বসেন। এরপর গাড়ি চালানো শুরু হয়। তিনি (পরীক্ষক) যাত্রী হিসেবে থাকেন। বিভিন্ন পথে যেতে নির্দেশনা দেন এবং চালানোর নিয়ম ঠিক আছে কিনা দেখেন। এরপর তিনি নেমে যাওয়ার পরে একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন। সেটাই চূড়ান্ত। সবকিছু ক্লিয়ার না থাকলে অযথা কারও লাইসেন্স পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই।’

তিনি বলেন, ‘কেউ যদি লাইসেন্স না পায়, তবে তাকে আবারও ‍শুরু থেকে একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হবে। কেবল স্টিয়ারিং ধরতে জানলে বা গাড়ি চালাতে জানলেই লাইসেন্স হবে না, সব নিয়ম মেনে গাড়ি চালানো জানতে হবে।’

বাংলাদেশের মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী, চালকের লাইসেন্স পেকে শিক্ষাগত যোগ্যতা, চিকিৎসকের সনদ থেকে শুরু করে বেশ কিছু কাগজপত্র দরকার হয়। এরপর নির্ধারিত স্থানে গিয়ে শুরুতে লিখিত পরীক্ষা এবং তারপরে প্র্যাকটিক্যাল ও ট্রাফিক সিগন্যাল চেনার পরীক্ষা হয়। এর সবকয়টি পরীক্ষাতেই কোনোমতে পার করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। যদিও যারাই পরীক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছেন বাংলাদেশে, তারা সবাই জানেন যে কাগজ থেকে শুরু করে গাড়ি চালানো ও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার সবই বানানো যায়। সব জায়গায় ‘সিস্টেম’ আছে।

তবে যে পথে লাইসেন্স দেওয়া হয়—সে পথ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ঠিকই আছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের রোড সেফটি উইংয়ের পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশে গাড়ির সংখ্যার চেয়ে এখনও চালকের সংখ্যা কম আছে। যদি যাচাই-বাছাই ছাড়া লাইসেন্স দেওয়া হতো, তাহলে এই সংখ্যা আরও বাড়তো।’ বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলাপের দরকার আছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘লাইসেন্স তো আমরা একা দেই না। একটা কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি হয়ে থাকে। সেখানে জেলা প্রশাসনও জড়িত। পরীক্ষা- নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেভাবে নেওয়া হয়, আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা ঠিকই আছে।’

‘যে প্রক্রিয়ায় লাইসেন্স দেওয়া হয়— তাতে দক্ষ চালক পাওয়া কঠিন’ মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কোনও ব্যক্তি সর্বসাধারণের ব্যবহৃত কোনও রাস্তায় গাড়ি চালাতে পারবেন না। বিআরটিএ’র তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা হচ্ছে—আবেদনকারীকে ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে। দেখা গেছে, অনলাইনে আবেদনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম এসএসসি পাস দেখাতে হয়।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক মনে করেন, সঠিকভাবে লাইসেন্স দিলে দুর্ঘটনা কমে আসবে এবং সড়কে বিশৃঙ্খলা কমবে। একইসঙ্গে তিনি মনে করেন, নতুন পরিকল্পনায় সড়কে শৃঙ্খলা আনার জন্য দ্রুত লক্কড়-ঝক্কড় বাস উচ্ছেদ করে উন্নত দেশের আদলে স্মার্ট, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের বদলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাস কোম্পানি পরিচালনায় দক্ষ, অভিজ্ঞ ও কারিগরি জ্ঞানসমৃদ্ধ পরিচালক নিয়োগ দিয়ে বিআরটিসি পরিচালনা করা গেলে প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনক করার পাশাপাশি যাত্রী পরিবহন খাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।