বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে, নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) থেকে সেবা নিতে গিয়ে। বিবিএস-এর ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস) ২০২৫’ জরিপের তথ্য অনুসারে, গত এক বছরে বিআরটিএ থেকে সেবা নেওয়া নাগরিকদের ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ ঘুষ বা দুর্নীতির সম্মুখীন হয়েছেন।
সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঘুষ-দুর্নীতির অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বিআরটিএর পরেই রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো; যা ৬১ দশমিক ৯৪ শতাংশ), পাসপোর্ট অফিসে ৫৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে এমন তথ্য প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-এর ১৬ নম্বর অভীষ্টের ছয়টি সূচক মূল্যায়নে এই জরিপ পরিচালিত হয়। দেশের ৬৪ জেলার ১ হাজার ৯২০টি প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট থেকে ৪৫ হাজার ৮৮৮টি থানার ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী মোট ৮৪ হাজার ৮০৭ জন নারী-পুরুষের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এতে দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তাবোধ, সুশাসন, সরকারি সেবার মান, দুর্নীতি, ন্যায়বিচার ও বৈষম্য বিষয়ে বিস্তৃত চিত্র তুলে ধরেছে।
নিরাপত্তা বিষয়ে নাগরিক উপলব্ধি
জরিপ অনুযায়ী, ৮৪ দশমিক ৮১ শতাংশ নাগরিক সন্ধ্যার পর নিজ এলাকায় একা চলাফেরা করতে নিরাপদ বোধ করেন। তবে এখানে রয়েছে স্পষ্ট লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য—পুরুষের ক্ষেত্রে এ হার ৮৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ, নারীর ক্ষেত্রে ৮০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। শহরাঞ্চলের নিরাপত্তাবোধ ৮৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও গ্রামাঞ্চলের তুলনায় ৮৫ দশমিক ৩০ শতাংশের কিছুটা কম।
নিজ বাসায় নিরাপত্তাবোধের ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশি—৯২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এর মধ্যে নারীর ক্ষেত্রে ৯১ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৯৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
মতপ্রকাশ ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ
মাত্র ২৭ দশমিক ২৪ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, তারা সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে মত প্রকাশ করতে পারেন। পুরুষদের মধ্যে এ হার ৩১ দশমিক ৮৬ শতাংশ, যেখানে নারীদের মধ্যে ২৩ দশমিক ০২ শতাংশ। অন্যদিকে, ২১ দশমিক ৯৯ শতাংশ নাগরিক বিশ্বাস করেন, তারা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কোনোভাবে প্রভাব ফেলতে পারেন।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় আস্থার চিত্র
গত এক বছরে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন ৪৭ দশমিক ১২ শতাংশ নাগরিক। সেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৮২ দশমিক ৭২ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবাকে সহজপ্রাপ্য এবং ৮৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ সেবার ব্যয়কে সহনীয় মনে করেন।
তবে স্বাস্থ্যসেবার মান ৬৫ দশমিক ০৭ শতাংশ, স্বাস্থ্যকর্মীদের আচরণ ৬৩ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং সময় দেওয়া ৬৩ দশমিক ১৯শতাংশ—এসব ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম সন্তুষ্টি দেখা গেছে।
সরকারি শিক্ষায় ইতিবাচক প্রবণতা
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪০ দশমিক ৯৩ শতাংশ নাগরিক জানিয়েছেন, তাদের অন্তত একটি সন্তান সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। প্রাথমিক স্তরে ৯৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ নাগরিক বিদ্যালয়ে সহজ প্রবেশাধিকার ও ৯২ দশমিক ৬৬ শতাংশ ব্যয়কে সহনীয় বলে মন্তব্য করেন।
মাধ্যমিক স্তরে এ হার কিছুটা কম—৮২ দশমিক ২০ শতাংশ ও ৮০ দশমিক ৮৬ শতাংশ। শিক্ষার মান বিষয়ে প্রাথমিক স্তরে ৬৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৭১ দশমিক ৮৬ শতাংশ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
অন্যান্য সরকারি সেবার মান
পরিচয়পত্র বা নাগরিক নিবন্ধনের মতো সেবায় ৭৮ দশমিক ১২ শতাংশ নাগরিক সেবার প্রাপ্যতা এবং ৮৬ দশমিক ২৮ শতাংশ ব্যয়কে গ্রহণযোগ্য মনে করেন। তবে কার্যকারিতা ৬২ দশমিক ৬০ শতাংশ, সময়মতো সেবা ৫১ দশমিক ২৮ শতাংশ ও সম-আচরণ ৫৬ দশমিক ২৬শতাংশ—এ তিনটি সূচকে সন্তুষ্টির হার তুলনামূলকভাবে কম।
বিচারপ্রাপ্তি ও বিরোধ নিষ্পত্তি
গত দুই বছরে ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ নাগরিক কোনও না কোনও বিরোধের মুখোমুখি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বিচারপ্রক্রিয়ার আওতায় আসতে পেরেছেন—এর মধ্যে ৪১ দশমিক ৩৪ শতাংশ আনুষ্ঠানিক (আদালত বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) এবং ৬৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক (কমিউনিটি নেতা বা আইনজীবী) প্রক্রিয়ায় সেবা পেয়েছেন।
বৈষম্য ও হয়রানি
জরিপ অনুযায়ী, গত এক বছরে ১৯ দশমিক ৩১ শতাংশ নাগরিক কোনও না কোনও ধরনের বৈষম্য বা হয়রানির শিকার হয়েছেন। নারীদের মধ্যে এই হার ১৯ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। শহরাঞ্চলে বৈষম্যের হার ২২ দশমিক ০১ শতাংশ, যা গ্রামাঞ্চলের ১৮ দশমিক ০৭ শতাংশের চেয়ে বেশি।
বৈষম্যের প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে আর্থ-সামাজিক অবস্থা; যা ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং লিঙ্গ ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। প্রধান স্থানগুলো হলো—পরিবার ৪৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ, গণপরিবহন বা উন্মুক্ত স্থানে ৩১ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং কর্মস্থলে ২৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। তবে এই ভুক্তভোগীদের মধ্যে মাত্র ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ বিষয়টি রিপোর্ট করেছেন—যা সমাজে ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির অভাব ও সচেতনতার ঘাটতির প্রতিফলন।