এক বছর শেষ, মশা নিধনে ডিএনসিসি’র ল্যাব কার্যক্রম শুরু হবে কবে?

মশা নিধনে সহায়ক হিসেবে ল্যাব প্রতিষ্ঠার কথা জানিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এই তথ্য জানানোর এক বছরেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি তারা। মশার প্রজাতি নির্ধারণ করার জন্য নিজস্ব কোনও পরীক্ষাগার না থাকায় চুক্তির মাধ্যমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ল্যাব ব্যবহার করছে ডিএনসিসি। চুক্তি অনুযায়ী জাবির ল্যাবে আধুনিক যন্ত্র ও অন্যান্য সহযোগিতা দেওয়ার কথা, তবে গত ৭ মাসে সে কথাও রাখা হয়ে ওঠেনি।

২০২৩ সালের জানুয়ারির শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা স্টেটের মায়ামি ডেইড কাউন্টি ঘুরে এসে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, এতদিন পর্যন্ত ভুল পদ্ধতিতে ঢাকার মশা নিধন করা হচ্ছিল। তাই সঠিক পদ্ধতি প্রয়োগে সচেতনতা বৃদ্ধি, ল্যাব প্রতিষ্ঠা, নতুন ধরনের কীটনাশকের ব্যবহারসহ ব্যবস্থাপনাগত নানা পরিবর্তন করা হবে।

তবে বাস্তবে গত ১ বছর ধরে সেই পুরনো পদ্ধতিতেই মশা নিধনের চেষ্টা চালিয়ে আসছে ডিএনসিসি।

এর মাঝে শিশুদের ডেঙ্গুর বিষয়ে সচেতন করতে মায়ামির স্কুল শিশুদের একটি বই বাংলায় অনুবাদ করে ছাপানো হয়। বইটির নাম ‘মশার কামড় ক্ষতিকর’। প্রাথমিকভাবে ১ লাখ বই ছাপানো হয় বলে জানায় ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। এগুলো বিভিন্ন স্কুলে বিতরণ করেন মেয়র আতিক। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে লিফলেটও বিরতণ করা হয়। এতে যুক্ত করা হয় বিএনসিসি ও স্কাউট সদস্যদের। তবে তা বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারেনি।

বরং গত বছর ঢাকায় সর্বাধিক মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়। জুলাই মাসব্যাপী আওয়াতাধীন এলাকায় ডেঙ্গু মশা নিধনে অভিযান চালায় ডিএনসিসি। অভিযানে কোথাও ডেঙ্গু মশার লার্ভা পাওয়া গেলে ওই ভবন মালিককে জরিমানা করা হয়। মাসব্যাপী এই অভিযানে দুই কোটি টাকা আদায় করা হয়।

গত বছর মশা নিধনে ডিএনসিসির বড় উদ্যোগ ছিল নতুন ধরনের কীটনাশক ওষুধ ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস সেরোটাইপ ইসরায়েলেন্সিস’কে (বিটিআই) পরিচয় করিয়ে দেওয়া। সেখানেও বড় ধরনের সমালোচনার মুখে পড়ে ডিএনসিসি। পরিচিত কোম্পানির নাম জালিয়াতি করে পাঁচ টন ওষুধ আনে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মার্শাল এগ্রোভেট। যার মূল্য ১ কোটি ৬৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা। তবে ডিএনসিসির দাবি, জালিয়াতি প্রকাশ পাওয়ার পর এক টাকাও দেওয়া হয়নি অভিযুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে। এই ঘটনার পর এই ওষুধ ব্যবহার বন্ধ করে দেয় ডিএনসিসি।

তবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছিল মশা নিধনে কীটতত্ত্ববিদের সম্পৃক্ততা, ল্যাব প্রতিষ্ঠা ও ডেঙ্গু মৌসুম শুরুর আগেই মাঠ পর্যায়ে কাজ বাড়ানোর। আর এই সবগুলোতেই পিছিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।

গত বছরের ২৪ জুলাই মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে গবেষণা কার্যক্রমে সহায়তার উদ্দেশ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে ডিএনসিসি। ২০২৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত ল্যাব ব্যবহারের জন্য এ সমঝোতা সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী ডিএনসিসির পক্ষ থেকে জাবির ল্যাবে আধুনিক মাইক্রোস্কোপ, কম্পিউটার, একটি এসি ও ল্যাব সংস্কার করে দেওয়ার কথা। পাশাপাশি ডিএনসিসি থেকে দুই জন কর্মচারী ল্যাবের কাজে সহযোগী হিসেবে কাজ করবেন।

এ গবেষণার কাজে মূল দায়িত্ব পালন করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার ও তার টিম। এছাড়া ভবিষ্যতে ডিএনসিসির সহায়তায় জাবিতে ইনস্টিটিউট অব ভেক্টর কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টার স্থাপনের আশ্বাস দেওয়া হয়।

এই ল্যাবের কাজ হবে বিভিন্ন এলাকা থেকে মশার প্রজননস্থল খুঁজে বের করে সেখান থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা ও মশার ডিম সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মশার প্রজাতি আলাদা করা। এবং সেই মশার ধরন বুঝে পরিমিত ওষুধ স্প্রে করে স্ব স্ব প্রজাতির মশা ধ্বংস করা।

তবে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এক বছর পেরিয়ে গেলেও ল্যাব চুক্তির একটি উপাদানও দেয়নি ডিএনসিসি। এর মাঝে বেশ কয়েকবার মেয়র আতিক ল্যাবের কথা বলেন। তবে কাজ কিছু এগোয়নি।

এ বিষয়ে গত ১১ ফেব্রুয়ারি কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে আমাদের ল্যাবে কিছু বেসিক জিনিসপত্র দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এগ্রিমেন্ট সই করার পর আর কিছুই এগোয়নি। ভেবেছিলাম ডিএনসিসি থেকে তিন জন লোক দিলে আমি প্রশিক্ষণ দেবো। এই তিন জন মাঠে ও ল্যাবে কাজ করবে। তাদের কাজের জন্য মাইক্রোস্কোপ লাগবে। একটা কম্পিউটার ও প্রিন্টারও দরকার। এছাড়া ল্যাবের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি যেহেতু মশার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। সে জন্য এসি প্রয়োজন।

যথাসময়ে ল্যাব প্রতিষ্ঠা হলে ডেঙ্গুর প্রস্তুতি মৌসুমের আগে থেকেই নেওয়া যেত জানিয়ে তিনি বলেন, ল্যাব প্রস্তুত থাকলে অনেক এগোনো যেত। প্রতি মাসে যে মৌসুমি মশার উৎপাদন বাড়ছে, তা কীভাবে বাড়ছে, কেন বাড়ছে এসব তথ্য পাওয়া যেত এবং তথ্যগুলো মশা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতো।

স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে আসা কীটতত্ত্ববিদের কোনও কাজ নেই

মশা নিয়ন্ত্রণে মশার প্রজাতি নির্ণয়, স্থানভিত্তিক মশার ঘনত্ব, অধিক মশা উৎপাদনের কারণ এবং মশক নিধনকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ১০ জন কীটতত্ত্ববিদের জন্য আবেদন করে স্বাস্থ্য অধিদফতরে। সেখান থেকে ৫ জনকে দেওয়া হয় ডিএনসিসিতে। এটাকে বড় প্রাপ্তি হিসবে অবহিত করেন ডিএনসিসির মেয়র। গত ৫ ফেব্রুয়ারি নগরভবনে ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় বছরব্যাপী আমাদের প্রস্তুতি এবং করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে মেয়র বলেন, এই প্রথম স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে কীটতত্ত্ববিদ পেয়েছি। আমরা ১০ জনের জন্য আবেদন করেছিলাম। পাঁচ জন পেয়েছি। এটা একটা বিরাট মুভমেন্ট।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাঁচ কীটতত্ত্ববিদের মধ্যে তিন জন ডিএনসিসিতে যুক্ত হলেও এখনও দুই জন কাজে যুক্ত হননি। এই দুই জনের একজন ডিএনসিসিতে না আসার জন্য মামলা করেছেন বলেও জানায় ডিএনসিসির একটি সূত্র। আর যুক্ত হওয়া তিন জনের একজন মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করলেও বাকি দুই জন কোনও কাজে নেই।

ডিএনসিসিতে যুক্ত কীটতত্ত্ববিদরা কী ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন জানতে চাইলে গবেষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, আমাদের ল্যাব থেকে যে ডাটা আসবে আমরা সেটা তাদের দেবো। তারা সেই ডাটা মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করবে। তারা যদি ল্যাবে কাজ করে তাহলে সমন্বয় করে কাজ করবো। না এলেও সমস্যা নাই। একই ডাটার ওপর কাজ করবো আমরা সবাই।

এ বিষয়ে জানতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মীর খায়রুল আলম ও ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন দিয়েও যোগাযোগ করা যায়নি।

ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন বলেন, ল্যাবের বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। আমাদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম নতুন এসেছেন। তিনি ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসেছেন।