বইয়ের প্রচার কি বইমেলা-কেন্দ্রিক?

ফেব্রুয়ারি এলেই বইয়ের প্রচার-প্রচারণায় মুখর থাকে পত্রিকার পাতা। একটা সময় শুধু লিফলেট বিতরণ আর পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই বইয়ের প্রচার ও বিপণনের কর্মযজ্ঞ চালাতেন প্রকাশকরা। এখন তো আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে বই প্রচারের ধরন। পত্রিকার পাশাপাশি ইন্টারনেট জগতেও চলছে বইয়ের প্রচার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে প্রকাশকরা চেষ্টা করছেন—অন্তত ভার্চুয়াল জগতে প্রচার করে বই বিক্রি বাড়াতে। যদিও লেখকরা মনে করেন, বাংলাদেশে বইয়ের প্রচার ব্যবস্থাই এখনও গড়ে ওঠেনি।

মেলায় কথা হচ্ছিল আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গনির সঙ্গে। বইয়ের প্রচার ব্যবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইলেকট্রনিক মিডিয়া কিংবা প্রিন্ট পত্রিকায় বিজ্ঞাপন এখন ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। আর এ জন্যই আমরা ঝুঁকছি অনলাইন প্রচারণায়। ঠিক কতটুকু বিনিয়োগ করছি তা সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে বইমেলার নীতিমালা হচ্ছে—২৫ শতাংশ বিনিয়োগ করা। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’  

তবে প্রচারণা যে শুধুই বইমেলাকেন্দ্রিক—এমন বক্তব্য মানতে নারাজ মাওলা ব্রাদার্সের প্রকাশক আহমেদ মাহমুদুল হক। তিনি বলেন, ‘প্রচার-প্রচারণা বছরজুড়েই থাকে। তবে বইমেলার সময় এটা বেড়ে যায়।’

তিনিও জানালেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের রেট বেশি। আর তাই তিনিও ঝুঁকেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মাহমুদুল হক বইয়ের প্রচারে পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতার একসময়ের ভূমিকার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘এখন তো হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ পত্রিকাই সাহিত্য পাতা বের করে না। তাই সবাই অনলাইনমুখী প্রচারে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে।’

বইয়ের প্রচারে ‘বুক রিভিউ’ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বইয়ের প্রচারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে বুক রিভিউ। আগে দুই-একটা পত্রিকা বুক রিভিউ ছাপাতো। এখন সেরকম দেখা যায় না। তবে আমাদের প্রকাশনা থেকে অনলাইন বুক রিভিউর জন্য বিনিয়োগ করা হয়।’

কথা প্রকাশ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন অনলাইনমুখী প্রচারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলেও লেখকের ভূমিকাকে প্রাধান্য দিতে চান। তিনি বলেন, ‘অনেক লেখক নিজের বইয়ের প্রচারের জন্য বইয়ের ছবি-সংবলিত টি-শার্ট করেন। এটা আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট। লেখকরা যখন নিজেদের বই প্রচার করেন, তখন প্রকাশকরা স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি সুবিধা পান।’

ঐতিহ্য প্রকাশনী আরেকটু এগিয়ে কাজ করছে বলে জানালেন প্রকাশক আরিফুর রহমান নাঈম। তিনি জানালেন, বছরব্যাপী বই প্রচারে কাজ করে ঐতিহ্য। বই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানান আয়োজন ও অফারের মাধ্যমে পাঠকের আগ্রহ বাড়াতে চেষ্টা করে যাচ্ছে ঐতিহ্য। শুধু তাই নয়, বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজস্ব মাল্টিমিডিয়া টিম গড়ে তুলেছে তারা। যেখান থেকে ভিডিওগ্রাফির মাধ্যমেও বইয়ের প্রচারণা চালিয়ে আসছে ঐতিহ্য।

নাঈম বলেন, ‘আমরা প্রকাশনার শুরু থেকেই বিভিন্ন ধরনের ব্যতিক্রমী আয়োজন করে আসছি। বুক রিভিউ নিয়ে ঐতিহ্য প্রায় সময়ই কাজ করে থাকে। অডিও ভিজুয়াল বুক রিভিউয়ের মতো নতুন ও ভিন্নধর্মী আয়োজনও হয়ে থাকে বছরের বিভিন্ন সময়ে।’ বছরব্যাপী বইয়ের প্রচার-প্রচারণার বিষয়ে এই প্রকাশক বলেন, ‘ঐতিহ্যের বইয়ের প্রচারণা শুধু বইমেলাকেন্দ্রিক থাকে না কখনোই।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রকাশকদের বই প্রচারের বিষয়টি নিয়ে গবেষক ও লেখক সালেক খোকন বলেন, ‘বড় কিছু প্রকাশনী সংস্থা ছাড়া বেশিরভাগেরই ফেসবুকে প্রচার নেই। এমনকি অনেকের তো কোনও ওয়েবসাইটও নেই। অনলাইন প্রচার ও বিক্রিতেও সারা বছর অনেকেরই তেমন কোনও চেষ্টা আমরা দেখি না।’

সালেক খোকন আরও বলেন, ‘একসময় প্রকাশকরা পাণ্ডুলিপির মান দেখে বই প্রকাশ করতেন, যা এখন খুব কম হচ্ছে। ফলে যে কেউ বই প্রকাশ করতে পারে। অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা কায়দায় ফ্যান-ফলোয়ার তৈরি ও বই প্রকাশ করে সেটার প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে বিক্রি বাড়িয়ে ফেলে। এতে বই বিক্রি বাড়লেও পাঠক বাড়ছে না। এভাবে বের করা বই যে সবই খারাপ, সেটাও বলা যাবে না। প্রচার দরকার আছে, কিন্তু বিক্রি বাড়ানো আর পাঠক তৈরি করা এক বিষয় নয়।’

তিনি মনে করেন, বইয়ের প্রচারে এখন আলাদা বুক প্রমোটিং হাউজ হওয়া প্রয়োজন। যেখানে প্রকাশক ও পাঠক তার বইয়ের প্রচার করতে পারবেন।’

অপরদিকে প্রকাশকদের এত উদ্যোগের মধ্যেও খুব একটা সন্তুষ্ট নন বর্তমান সময়ের তরুণদের কাছে জনপ্রিয় লেখক কিঙ্কর আহসান। তিনি মনে করেন, বইয়ের প্রচারণা শূন্যতেও নেই, আছে মাইনাসে। তিনি বলেন, ‘বুক রিভিউ কিংবা বই আলোচনা নিয়ে প্রকাশকরা যা করছেন তা যথেষ্ট না। এটা কেবল ঢাকা বা তার আশপাশের এলাকায় দেখা যায়। এটার বিস্তৃতি দেশব্যাপী হওয়া উচিত ছিল।’

কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে দেশব্যাপী প্রচারণা তো সম্ভব—এমন প্রশ্নের উত্তরে কিঙ্কর আহসান বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণার বাইরে আরও অনেকভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। এক্ষেত্রে ওডিসি, ওবিডি কিংবা এসএমএস মার্কেটিং ইত্যাদির মাধ্যমে আরও বেশি প্রচার-প্রচারণা দরকার।’

তবে শেষ পর্যন্ত লেখনীর শক্তিতেই পাঠকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব বলে মনে করেন কিঙ্কর। তিনি জানান, বিশেষ করে তরুণরা যদি তাদের লেখনীর মাধ্যমে ভালো কিছু ফুটিয়ে তুলতে পারেন, তাহলে তারা স্বাভাবিকভাবেই পাঠকের কাছে সমাদৃত হবেন। তখন তাদের নিজস্ব একটা পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হবে। আর প্রকাশকরাও খুব উৎসাহের সঙ্গে তাদের বইয়ের প্রচারে বিনিয়োগ করবেন।

এই লেখক মনে করেন, বইয়ের উৎসব শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে নয়, বছরজুড়ে হোক।

প্রচারণায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ প্রকাশকই জানালেন—তারা ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত খরচ করেন। তবে প্রকাশকরা স্বীকার করেন বইমেলার সময়টিতেই বেশি প্রচারণা হয়। কারণ, তখন বেশি পাঠক মেলায় আসেন। কথা প্রকাশের প্রকাশক জসিম উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সর্বোচ্চ সেলের টার্গেট নিয়েই প্রচারণার চেষ্টা করা হয়। কারণ, বই বিক্রির সঙ্গে লেখকের রয়্যালটির সম্পর্ক আছে। মেলায় প্রচার বেশি হয়। কারণ, পাঠকরা এসময় মেলায় এসে বেশি বই কেনেন।’