ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) বিপরীত পাশের ফুটপাতে প্রায়ই দেখা মেলে শিশুর জটলা। তাদের বয়স আনুমানিক ৮ থেকে ১৩ বছর করে। তাদের কাছে গিয়ে দেখা যায়, তারা বিশেষ একটি পলিথিনে মুখে গুঁজে শ্বাস নিচ্ছে। কোনও খাবার নয়, এই পলিথিনে থাকে আঠা দিয়ে বানানো প্রাণঘাতী মাদক ‘ড্যান্ডি’। কচি প্রাণে এসব মাদক সেবনের ভয়াবহতা কতটুকু, তা সম্পর্কে অবগত নয় তারা।

শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিয়মিতই এই মাদক গ্রহণ করে ছিন্নমূল শিশুরা। তাদের সবার জীবনের গল্প প্রায় একই রকম। কারও শুধু বাবা আছেন, কারও শুধু মা আছেন। যাদের মা-বাবা দুজনেই আছেন, মা ভিক্ষা করেন কিন্তু বাবা খোঁজ নেন না।

শিশু রাকিবুল হাসানের (ছদ্মনাম) বয়স আনুমানিক ১০ বছর। সে নিয়মিত এ মাদক নেয়। জানতে চাইলে সে বলে, ‘ড্যান্ডি টানলে ভালো লাগে, ক্ষুদা লাগে না।’ এটা কিনতে টাকা পাওয়া যায় কোথায়, জানতে চাইলে তার ঝটপট উত্তর, ‘কেন, বোতল বেচি, কাজ করি, মানুষ টাকা দেয়, তা দিয়ে কিনি।’

শুধু এফডিসির পাশের ফুটপাতে নয়, রাজধানীর কাওরানবাজার, বিভিন্ন পরিত্যক্ত ফুটওভার ব্রিজের ওপর, বিভিন্ন নোংরা এলাকার আনাচকানাচ ও বস্তি এলাকায় প্রায়ই চোখে পড়ে এমন দৃশ্য।

মাঝেমধ্যে পুলিশ অভিযান চালিয়ে এসব পথশিশুকে আটক করে পুনর্বাসনে পাঠায়। তবে বেশির ভাগ শিশু থেকে যায় অন্ধকার জগতে। একসময় এরা বড় হয়ে কেউ নাম লেখায় ছিনতাইকারী, ডাকাতি ও সন্ত্রাসীদের মতো অপরাধজগতে। এসব পথশিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাবে কে, তা নিয়ে বরাবরই থেকে যায় প্রশ্ন।

পুলিশের একটি সূত্র বলছে, তাদের পুনর্বাসন করার দায়িত্ব সমাজকল্যাণ বিভাগের। তবু পুলিশের যে দায়িত্ব যদি কোনও অনিয়ম দেখলে তাদের ধরে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। তাদের দেখভালের জন্য যেসব সংস্থা দায়িত্বে রয়েছে, তাদের ভূমিকাও আরও বাড়াতে বলছে পুলিশ।

তবে সমাজসেবা অধিদফতরের একটি সূত্র বলছে, দেশের সার্বিক কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্য পুলিশ রয়েছে। পুলিশের দায়িত্ব অনিয়ম, অনাচার প্রতিরোধে এসব শিশুকে আইনের আওতায় আনা। পুলিশের সহযোগিতা ছাড়া ড্যান্ডি সেবনকারী শিশুদের ধরা সম্ভব নয়। পুলিশের সহযোগিতায় মাদকাসক্ত পথশিশুদের আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে সংশোধন করা যেতে পারে।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, চুরি-ছিনতাইয়ের মতো ঘটনার সঙ্গে পথশিশুদের জড়িত থাকার খবর প্রায়ই দেখা যায়। তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়। কিন্তু জামিনে বেরিয়ে এসে তারা আবার একই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ও নজরদারি বাড়াতে গত বছর পথশিশুদের তালিকা করতে কাজ করার কথা বলেছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।

ফুটপাতে অনায়াসে নেশার জগতে ডুবে যেতে দেওয়া হচ্ছে এই শিশুদের।

এ বিষয়ে ডিএমপির সংশ্লিষ্ট উপকমিশনারদের (ডিসি) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তালিকা তৈরির পর সমাজসেবা অধিদফতর এবং বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টিও দেখভাল করবেন ডিএমপির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা, নির্দেশনায় তা বলা হয়েছিল।

মাদক নিয়ে নিয়মিত অভিযান চালান ডিএমপির তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মহসীন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিশু আইনে মাদক মামলা না থাকায় এখানে পুলিশের কিছু করার নেই। তবে যেকোনও অনিয়মের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান আছে। পথশিশুদের কোনও অনিয়ম দেখলে আমরা সেটা আমলে নিয়ে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিই। যেসব পথশিশু ড্যান্ডি সেবন করে, মাদক নেয়, তাদের অনেককে ধরে মিরপুরে শিশু সংশোধনাগারে আমরা পাঠিয়েছি। আমাদের যে দায়িত্ব, সেটি নিয়মিত করছি। তবে পথশিশুদের দেখভাল করার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত রয়েছেন, তাদের তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না। হয়তো তাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

ওসি আরও বলেন, পথশিশুদের পুনর্বাসন করার দায়িত্ব সমাজকল্যাণ অধিদফতরসহ আরও সংশ্লিষ্ট যারা রয়েছে, তাদের। তারা যৌথভাবে কাজ করে এসব ছিন্নমূল শিশুর পুনর্বাসন ঠিকঠাক নিশ্চিত করতে পারে। তবে আমাদের কাজটা আরও সহজ হয়।

একটি উদাহরণ দিয়ে মহসীন বলেন, গত বছর নিজ গ্রামে ঈদ কাটিয়ে শহরে ফেরার পথে ফার্মগেট এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে এক পুলিশ কনস্টেবল নিহত হয়েছিলেন। এ ঘটনায় জড়িত তিনজনই ওই রাতে মাদক সেবন করেছিল ও মাদকাসক্ত ছিল।

এ বিষয়ে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন্স) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, যেসব পথশিশু ড্যান্ডি মাদক সেবন করে, তাদের বেশির ভাগই অভিভাবকহীন। তাদের ধরে মা-বাবার কাছে বুঝিয়ে দেবেন, সেটাও সম্ভব নয়। ফলে এ অপরাধজগৎ থেকে তাদের ফিরিয়ে আনা শুধু পুলিশের পক্ষে একা সম্ভব নয়, সমাজের সব স্টেকহোল্ডারকে এগিয়ে আসতে হবে। অবশ্যই তাদের নিয়ে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে। সবাই এগিয়ে এলে তাদের সঠিক পুনর্বাসন করা সম্ভব। তবে পথশিশুদের মধ্যে যারা মাদকাসক্ত কিংবা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক  বলেন, ছোট ছোট অপরাধ শিখে একসময় বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এসব শিশু। আজ ড্যান্ডি সেবন করছে পথশিশুরা, কাল হয়তো তারা বড় সন্ত্রাসী হয়ে উঠবে। তার আগেই সুবিধাবঞ্চিত এসব পথশিশুর জন্য পুনর্বাসন করাটা জরুরি। আর সেটি বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক ও বেসরকারিভাবে তাদের জন্য কাজ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা যদি ইতিহাস দেখি, তাহলে দেখা যায় পথশিশু থেকে কীভাবে শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়েছে। ফলে যদি এখনই সঠিক পুনর্বাসন না করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে না আনা হয়, পরবর্তী সময় তারাই হয়ে উঠবে রাষ্ট্রের জন্য হুমকি।