নানা অভিযোগে গত ১ মে গ্রেফতার হয়ে আলোচিত ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের’ চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার এখন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে আছেন। তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া তিনটি মামলায় দ্বিতীয় দফায় তাকে রিমান্ডে নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন ডিবির কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদে মিল্টন সমাদ্দারের কাছ থেকে ‘ভয়ংকর সব তথ্য’ পাচ্ছেন বলে জানান ডিএমপির ডিবি-প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। এরইমধ্যে মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রী মিতু হালদারকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অপরদিকে, ঢাকা ও সাভারের আশ্রমে অসহায় ও শারীরিকভাবে অচল ১৫৫ জন মানুষ অপেক্ষা করছেন মিল্টন সমাদ্দারের জন্য। মঙ্গলবার (৭ মে) বাংলা ট্রিবিউনের কাছে তারা মিল্টন সমাদ্দারকে নিয়ে বলেছেন অনেক আবেগঘন কথা। মিল্টন ছাড়া কেমন যাচ্ছে তাদের দিনগুলো, বলেছেন সেসবও।
সরেজমিনে মঙ্গলবার (৭ মে) সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের কমলাপুর এলাকার বাহেরটেক গ্রামে মিল্টনের প্রতিষ্ঠিত চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার ফাউন্ডেশনে গিয়ে দেখা যায়— আশ্রিত সবাই মিল্টন সমাদ্দারের ফেরার অপেক্ষায় আছেন। কেউ কাঁদছেন, কেউবা দুহাত তুলে তার জন্য দোয়া করছেন। বিরুলিয়ায় সম্প্রতি ৬৫ শতক জমির ওপর চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার ফাউন্ডেশনের নামে ছয় তলা একটি ভবন নির্মাণ করেন। এই ভবনে বর্তমানে ১৩২ জন আশ্রিত রয়েছেন। ভবনের সামনের বামপাশে রয়েছে টিনশেডের পার্কিং, ক্যান্টিন ও রান্নাঘর। ভবনের পেছনে করা হয়েছে কবরস্থান। আর ভবনের ডানপাশে স্টাফদের জন্য নামাজের স্থান ও থাকার বাসস্থান করা হয়েছে।
ছয় তলা ভবনটির নিচতলায় অফিস, জরুরি বিভাগ, ফার্মেসি ও স্টোর রুম রয়েছে। দোতলায় মহিলা ওয়ার্ড দিয়েই শুরু হয়েছে আশ্রিতদের থাকার জায়গা। চারটি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪ নম্বর মহিলা ওয়ার্ডে বর্তমানে ১২ জন বৃদ্ধা নারী রয়েছেন। তৃতীয় তলায় পুরুষ ওয়ার্ড। সেখানে ১ নম্বর ওয়ার্ডে ১২ জন, ২ নম্বর ওয়ার্ডে ১০ জন, ৩ নম্বরে ৯ জন এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ১০ জন পুরুষ ও বৃদ্ধকে আশ্রয় ও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চতুর্থ তলায় শিশু ওয়ার্ড। এই আশ্রমে ২৮টি শিশু রয়েছে। ১৪টি শিশুর বয়স দুই বছরের নিচে। আর ১৪টি শিশুর বয়স দুই বছরের বেশি। এরমধ্যে ২০ জন শিশুই শারিরীক প্রতিবন্ধী। এই আশ্রম থেকেই সাত জন শিশু শমরিতা শিশু পল্লী নামের একটি স্কুলে লেখাপড়া করছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ভবনের পঞ্চম তলায় নারী ও বৃদ্ধাদের থাকার ওয়ার্ড। মহিলা-৫ নম্বর ওয়ার্ডে ১০ জন, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে ১০ জন, ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ১১ জন এবং ৮ নম্বর ওযার্ডে ১০ জন নারী রয়েছেন— যাদের বেশির ভাগের বয়স ৬০ বছরের বেশি। তারা শারিরীক প্রতিবন্ধী ও বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন। ষষ্ঠ তলায় পুরুষ-৫ নম্বর ওয়ার্ডে ১২ জন বৃদ্ধ রয়েছেন। এছাড়াও ভবনের ওপরে আরও একটি ফ্লোর বাড়ানোর কাজ চলছে।
রাজধানীর কল্যাণপুরের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের একটি ভাড়া ভবন ঘুরে দেখা যায়, দক্ষিণ পাইকপাড়ার একটি দোতলা ভবনে ২৩ জন আশ্রিত রয়েছেন। এরমধ্যে পাঁচ জন শিশু, ৭ জন পুরুষ ও ১১ জন নারী আছেন। ভবনের নিচ তলায় একটি অফিস কক্ষ, নারী ও শিশুদের চিকিৎসার জন্য তিনটি রুম রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় ২ ও ৮ নম্বর রুমে পুরুষদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ৩, ৪ ও ৭ নম্বর রুমে মিডিয়া ও অনলাইন কার্যক্রম করেন সংশ্লিষ্টরা। ৫ ও ৬ নম্বর রুমে থাকেন স্টাফরা।
তৃতীয় তলায় ১ নম্বর পুরুষ ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন রমজান আলী। প্রায় তিন বছর আগে তিনি টঙ্গী এলাকায় দুর্ঘটনায় একটি হাত হারান। পরে রাস্তায় পড়ে থেকে তার হাত ও দুই পায়ে পচন ধরে যায়। সেনাবাহিনীর সহায়তায় তিনি মিল্টনের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এ জ কেয়ারে এক বছর ধরে আশ্রয়ে আছেন। তিনি বলেন, মিল্টন দাদা তাকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলছেন। তার পায়ের ড্রেসিং করতেন মিল্টন। গত কদিন ধরে কেউ আর জানতেও চায় না কেমন আছেন তিনি।
শারীরিক প্রতিবন্ধী স্কুলশিক্ষক সেলিম। প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি মিল্টনের আশ্রমে আছেন। ভালো করে কথাও বলতে পারেন না। ২ নম্বর পুরুষ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়— তিনি মিল্টনের ছবি ধরে বাবা বাবা বলে কান্না করছিলেন। ২৮ বছর বয়সী আসাদ মিয়ার বাম পায়ের নখ পঁচে পোকায় ধরে যায়। তিনি বলেন, তার পচা আঙ্গুলগুলো কেটে ফেলে দেওয়ায় এখন ভালো আছেন। কিন্তু বাবা (মিল্টন) ছাড়া তাদের ভালো লাগে না। তার মতো করে কেউ সেবা দেয় না।
মাথার একাংশ ট্রেনের আঘাতে ক্ষত হয়েছে ১২ বছরের কিশোর আশিকের। কিছু গণমাধ্যমে তার কিডনি বিক্রির অভিযোগ তোলা হয়েছে। জানতে চাইলে আশিক তার পেট দেখিয়ে বলে, তার পেটে কোনও কাটা নাই। যখন রাস্তায় পড়ে ছিল তখন কেউ তার সামনে যেতো না। এখানে তার অপারেশন করার পর থেকে সে ভালো আছে।
২ নম্বর পুরুষ ওয়ার্ডের এক ৬০ বছরের বৃদ্ধ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তার টয়লেটের রাস্তায় ফোঁড়া হয়েছিল। সেখানে বড় রকমের ঘা ছিল। তিনি বলেন, ‘রাস্তা থেকে আমাকে তুলে এনে কী মিল্টন বাবা ভুল করেছেন! রাস্তা থেকে এনে গোসল করাইছে। সেলাই দিছে, পায়খানার রাস্তার ঘা ভালো হয়েছে। বাবা কি এটা ভুল করেছে। এই ভুলের কারণে বাবায় (মিল্টন) পুলিশের মার খায়।’
চতুর্থ তলায় শিশু ওয়ার্ডে ২৮ জন শিশু রয়েছে। এরমধ্যে ২০ জন প্রতিবন্ধী। বেশিরভাগই সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু। তারা এখানে কেন, কোথা থেকে এসেছে, এমন প্রশ্নে মিলি নামে এক কিশোরী জানায়, এটাই (আশ্রম) তাদের বাসা। তারা এখানেই থাকে। খায়-দায়, খেলা করে। পড়াশুনা করে। তারা তাদের বাবাকে (মিল্টন) ফেরত চায়। কারণ, এখন আর কেউ তাদের আদর করে না। খোঁজ নেয় না। শিশু মানিক চাদ বলে, মঙ্গলবার শমরিতা শিশু পল্লীর স্কুলে নার্সারির পরীক্ষা দিয়েছে সে। তার বাবা মিল্টন থাকলে কলম কিনে দিতো।
পঞ্চম তলার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিলকিস জানান, আমার শরীরে পোঁকা আছিল। এই আশ্রমের লোকেরা আমার পা ও শরীরের পোঁকা সারাইছে। যে আমারে ভালা করছে, তারে দেখতে চাই। তাকে দেখলেই ভালা হইয়া যামু।
চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের সহকারী মেডিক্যাল অফিসার মো. মাকসুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ আমরা রোগীদের ড্রেসিং, খাওয়া-দাওয়া ও চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ দিয়ে থাকি। বিশেষ করে যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী তাদের চিকিৎসা ও দেখাশুনার জন্য আলাদা লোক রাখা হয়েছে।’
আরও পড়ুন:
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো