মুখোশ পরিয়ে বেত্রাঘাত চড় থাপ্পড় লাথি, নির্যাতন না অন্য কিছু?

কখনও বেত্রাঘাত। কখনও চড়-থাপ্পড় আর বুকে-পিঠে লাথি চলতে থাকে অনবরত। কোনও তরুণ কিংবা যুবকের হাত-পা বেঁধে মুখোশ পরিয়ে চালানো হয় এ ধরনের নির্যাতন, যার পোশাকি নাম ‘ফেমডম সেশন’। নারীদের হাতে পুরুষদের নির্যাতন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উভয়পক্ষের সম্মতিতে এই কথিত নির্যাতন বা কার্যক্রম চলে। ধারণ করা হয় ভিডিও চিত্র। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিকৃত মানসিকতা বা যৌনাচারের আনন্দ অনুভব করা। আবার এই ভিডিও চিত্র ইন্টারনেটের মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে দিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করাও এর অন্যতম উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে এটা নতুন হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ফেমডন সেশন অনেকটা পুরনো।

পুলিশ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভয়ংকর তথ্য হলো—বেশ কয়েকটি সংঘবদ্ধ নারী-পুরুষের চক্র ফেমডম সেশন নামের এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। এই  কার্যকলাপের সঙ্গে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ তরুণরাও জড়িয়ে পড়ছে। তবে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, উভয়ের সম্মতিতে হলে সেটা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত না হলেও এ ধরনের কার্যক্রম সমাজে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তারা বলছেন, ফেমডম শব্দটি এসেছে ফিমেল ডমিনেশন থেকে। যেখানে সম্পর্কের নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব নারীর হাতে থাকে। এটি শুধু যৌনতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, দৈনন্দিন জীবনের কোনও সম্পর্কেও এর চর্চা হতে পারে।

ফেমডম (ফিমেল ডমিনেশন) সেশনের বিষয়টি প্রথমে নজরে গত ১ মে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ভাটারা থানা পুলিশ দুই নারীকে গ্রেফতারের পর। ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার জি ব্লকের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ‘ফেমডম সেশন’র নামে নির্যাতন ও পর্নোগ্রাফি প্রচারের অভিযোগে দুই নারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলো শিখা আক্তার (২৫) ও সুইটি আক্তার জারা (২৫)।

এ ঘটনায় মো. আব্দুল্লাহ নামে এক তরুণ ভুক্তভোগী ভাটারা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। বাংলা ট্রিবিউনকে মো. আব্দুল্লাহ বলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী। সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেনস্তা ও সম্মানহানির আশঙ্কা থেকে তিনি এর বেশি নিজের পরিচয় প্রকাশ রাজি হননি। এই তরুণ বলেন, এই চক্রের প্রধান টার্গেট স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণরা। ওই চক্রের নারীরা তরুণ-যুবকদের ফাঁদে ফেলে নেশাগ্রস্ত করার মাধ্যমে এই ‘ফেমডন সেশন’ করায়। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফেমডন সেশনের ভিডিও ধারণ করে এবং বিদেশি চক্রগুলোর কাছে চড়া দামে ওই ভিডিও বিক্রি করে থাকে। আবার এই একই ভিডিও দিয়ে পুরুষদের ব্ল্যাকমেইলিং করে থাকে।

পুলিশের কাছে দেওয়া অভিযোগপত্রে আব্দুল্লাহ উল্লেখ করেন, গত ২৯ এপ্রিল রাতে ফেসবুকের মাধ্যমে একটি অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করেন। ওই ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পুরুষদের উলঙ্গ করে শারীরিক নির্যাতন ও বিকৃত যৌনাচারের ভিডিও প্রচার করা হয়। এই কার্যকলাপে জড়িত ব্যক্তিরা টেলিগ্রাম ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমেও এসব ভিডিও ছড়িয়ে দেয়। জড়িত নারীরা নিজেদের ‘মিসট্রেস’ এবং পুরুষদের স্ল্যাব হিসেবে সম্বোধন করে থাকে। পুরুষরা টাকার বিনিময়ে তাদের কাছে এ ধরনের নির্যাতিত হতে আগ্রহী হন।

আব্দুল্লাহ বলেন, ‘গত ২৯ এপ্রিল শিখা আক্তার নামে একজনের সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন এবং তাদের দেওয়া বিকাশ নম্বরে ৫০০ টাকা পাঠান। পরবর্তীকালে তাকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় যেতে ঠিকানা দেওয়া হয়। পরদিন ৩০ এপ্রিল দুপুরে তিনি সেখানে যান। গিয়ে দেখতে পান যে শিখা আক্তার ও সুইটি আক্তারসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজন এক তরুণকে উলঙ্গ করে শারীরিক নির্যাতন এবং মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করছেন। পরে সেখান থেকে এসে ভাটারা থানায় অভিযোগ করেন।’ বাংলা ট্রিবিউনের কাছে তিনি দাবি করেন, এ চক্রকে শনাক্ত করার জন্যই তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। পরে তিনি বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করেন—যা পুলিশ মামলা হিসেবে নথিভুক্তির পর তদন্ত করছে।

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভাটারা থানার সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) ইকবাল হোসেন বলেন, এটা একটা বিকৃত যৌনাচার। এটা কোনও নির্যাতন নয়। মেয়েদের এই চক্রটি ফেমডম সেশন নামে একটা সেশন চালায়। যেখানে তরুণ-যুবকরা নিজের ইচ্ছায় ফেমডম সেশন বুকিং করে টাকার বিনিময়ে মার খেতে যেতো। যে সেশনে মেয়েদের হাতে চাবুকের পেটানো, পা চাটাসহ বিভিন্ন নির্যাতনের বিষয় থাকবে। মেয়েরা পিঠের ওপর বসে চাবুক দিয়ে পেটাবে। এটাতে তারা মজা পেতো। যিনি মামলা করেছেন তিনিও এই সেশন নিয়েছেন। পুলিশ তার মাধ্যমে ওই চক্রকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এখন তদন্ত চলছে। গ্রেফতারকৃতরা জেল হাজতে আছে। তদন্তের মাধ্যমে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত অন্যদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে।

এই ফেমডন সেশন সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ ধরনের বিকৃত মানসিকতার যৌনাচার বিভিন্ন দেশে আছে। আমাদের দেশেও যে এটা চলমান ছিল, সেটা আগে জানা যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কার্যকলাপে সমাজে এক ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তরুণরাই বেশি তাদের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হতে পারে। জীবনহানিও হতে পারে। এখনই এ ধরনের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।’

নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ‘উই ক্যান’র সমন্বয়ক জিনাত আরা হক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নারী-পুরুষ উভয়পক্ষ যদি সম্মতির ভিত্তিতে এটা করে থাকে, তাহলে সেটা কোনও অপরাধ নয়। আর ছেলে মারুক আর মেয়ে মারুক এটাতো ভালো জিনিস না। আর এতে নারীদের ইমেজ নষ্ট হওয়ারও কিছু নেই। তবে ফেমডন সেশনের নামে যে ভিডিও চিত্র ধারণ করে বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, সেটাতো তারা প্রচার করতে পারে না। এটা অবশ্যই অন্যায়। তারা এক ধরনের অমানবিক ও নিপীড়নমূলক একটা জিনিস তৈরি করে, সেটা দেখানোর চেষ্টা করছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা সমাজে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।’