অচল ডিএসসিসি, ভোগান্তির শেষ কোথায়?

বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে টানা আট দিন ধরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন তার সমর্থকরা। নগর ভবনে তালা ঝুলিয়ে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীরাও। ফলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রায় সব ধরনের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী।

চলমান এই আন্দোলন নগরভবন ছেড়ে ঠেকেছে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার তীরে। নগরভবনের আশেপাশে এই মুহূর্তে কারও অবস্থান না থাকলেও গেটে ঝুলছে তালা। সেবা পাবার কোনও দরজাই আপাতত খোলা নেই।

নগরভবনের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকটা অচল হয়ে পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ভাটা পড়েছে মশক নিধনসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কর্মসূচিতে। এমনকি অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা হলেও সরানোর কাজে নামেনি কেউ। ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম চাপা পড়েছে আন্দোলনে। অন্যদিকে, বৃষ্টির ফলে মশার উপদ্রব বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ দক্ষিণ সিটিতে বসবাসকারীদের জীবন। এসব কিছুর সমাধান আপাতত জানা নেই সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল কারোর।

বৃহস্পতিবার বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যমুনার সামনের সড়কে অবস্থান নেয় বিক্ষোভকারীরাদক্ষিণ সিটির বাসিন্দারা বলেছেন, নগরভবন কেন্দ্রিক সেবা বন্ধ থাকলেও মশক নিধনের জন্য ঔষধ ছিটানোসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন চালু রাখা জরুরি।

শাহিন আলম নামে দক্ষিণ সিটির ৪১ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত কয়েকদিন ধরে মশার উপদ্রব বেড়েছে। অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তায় ময়লা-আবর্জনা জমে আছে। এসব কিছু থেকে নগরবাসী দ্রুত মুক্তি পেতে চায়। যে যেভাবে খুশি আন্দোলন করুক কিন্তু তার জন্য জনভোগান্তি সৃষ্টি করা অপ্রত্যাশিত।

গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নগর ভবনের সামনে চলা আন্দোলনের কারণে নগর ভবনের ভেতরে ঢুকতে পারছে না সেবাগ্রহীতার। পুরান ঢাকার বাসিন্দা পিয়াল চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আন্দোলনকারীরা যৌক্তিক দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। কিন্তু তাদের কারণে আমরা সেবা নেওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। আমার মেয়ের জন্মনিবন্ধন নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছে। গত পাঁচ দিন ধরে অনেক চেষ্টা করেও সেই সমস্যার সমাধান করতে পারছি না। কবে নাগাদ এই সমস্যার সমাধান করতে পারবো তাও জানি না।

এদিকে গতকাল বুধবার (২১ মে) রাতে ইশরাক হোসেন নিজেই সশরীরে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। ফলে আন্দোলনের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ইশরাককে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া ছাড়াও নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরও দুই দাবি। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলমের পদত্যাগ। যেটি ইশরাক হোসেন স্বয়ং নিজেই দাবি করেছেন এবং ঘোষণা দিয়েছেন 'এই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত মাঠ ত্যাগ করবেন না।'

দুই উপদেষ্টার পদত্যাগের বিষয়ে ইশরাক হোসেন বলেন, যেহেতু এটা প্রতীয়মান যে আসিফ এবং মাহফুজ রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত আছেন, হয়তো আগামীতে সরাসরি যুক্ত হবেন এবং এটাও অনেকটা স্পষ্ট যে তারা নির্বাচন করবেন। তাহলে তাদের পদত্যাগের দাবি কি অযৌক্তিক? নাকি এটাই সঠিক পদক্ষেপ হবে এবং এতে তাদের নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের অবসান ঘটবে।

ইশরাক হোসেন আরও বলেন, এই দুই উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে বর্তমান সরকারের নিরপেক্ষতার ইমেজই বৃদ্ধি পাবে। এখনও মনে করি, সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দলীয় ও সাংগঠনিক কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারলে দেশ ও জনগণকে তারা আরও ভালো কিছু দিতে পারবে। দুই উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি থেকে সরার সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি।

ইশরাককে মেয়র পদে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার আন্দোলনে বিক্ষোভকারীরা বলেন, এত দিন আমরা শুধু ইশরাক হোসেনকে শপথ পাঠ করানোর দাবিতে আন্দোলন করেছি। কিন্তু এখন আমাদের দাবি উপদেষ্টা আসিফ আর মাহফুজের পদত্যাগ। যতদিন পর্যন্ত না তারা পদত্যাগ করবেন, ততদিন আমরা একইভাবে যমুনার সামনে আন্দোলন চালিয়ে যাবো এবং প্রয়োজনে আরও কঠোর কর্মসূচি দেবো। এছাড়াও ইশরাককে মেয়র পদে শপথ না করালে আমরণ অনশনের ঘোষণা দেওয়ার কথাও জানান আন্দোলনকারীরা।

তবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের এই আন্দোলনের যৌক্তিকতার কথা তুলে ধরলেও অনেকেই এটিকে কেবল জনদুর্ভোগের সঙ্গে তুলনা করেছেন। দক্ষিণ সিটির বাসিন্দা নূরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, হাসিনার আমলের সব নির্বাচনকে আমরা চোখ বন্ধ করে অবৈধ নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করি। বিএনপির সবাইও তাই ভাবে বলে আমি মনে করি। কিন্তু সেই অবৈধ নির্বাচনের মেয়র পদে ইশরাক যদি শপথ গ্রহণ করে তাহলে এক অর্থে সেই নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়া হবে।

দক্ষিণ সিটির এই বাসিন্দা আরও বলেন, গত সাত দিন ইশরাক হোসেন ঢাকা শহরে নাগরিক-দুর্ভোগ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক অপরিপক্বতা ও অপরিণামদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। অথচ তার উচিত ছিল এই আন্দোলন বন্ধ করে বরং নতুন করে নির্বাচনের কথা বলা। কারণ গত ১৫ মে এমনিতেই মেয়র পদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন মেয়র পদে শপথ নেওয়ার জন্য তার যেই আন্দোলন সেটা কেবলমাত্র জেদ থেকে, এছাড়া আর কিছু না।

বিএনপির নেতাকর্মীদের চলমান আন্দোলন স্থিতিশীল না হলে নগরভবনের কার্যক্রমে গতিশীলতা ফেরার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ইশরাক এবং উপদেষ্টা আসিফের দ্বন্দ্বে নগরবাসী যাঁতাকলে। ইশরাক যদি এই আন্দোলন না থামায় বা আসিফ যদি পদত্যাগ না করে তাহলে নগরভবনের গতিশীলতা ফিরবে না। কারণ সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ কর্মচারী এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।

ডিএসসিসির সেবা কার্যক্রমের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আন্দোলনের কারণে নগরভবন কেন্দ্রিক সকল সেবা বন্ধ। জোনাল অফিস কেন্দ্রিক সেবাগুলোও বন্ধ। দ্রুত সময়ের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত না আসলে জনগণের ভোগান্তি আরও বেশি হবে। সংশ্লিষ্ট যে তিনটি দফতরের সাথে যুক্ত তারা যদি এর সমাধান না দিতে পারে তাহলে আমাদের কিছু করার নেই।

নগরভবনে কর্মরত কর্মচারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার বিষয়ে ডিএসসিসির এই কর্মকর্তা বলেন, সরকার ট্রেড ইউনিয়ন চালু করায় এই সুযোগ তারা পেয়েছেন। তবে তাদের কার্যক্রম আরও সংবেদনশীল হওয়া উচিত। তাদের উচিত চলমান আন্দোলনের পাশাপাশি যার যার অবস্থান থেকে নাগরিক সেবা প্রদান, কারণ আমাদের প্রধান কাজ নাগরিক সেবা।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির ইশরাক হোসেনকে পৌনে ২ লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হন। গেলো ২৭ মার্চ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০২০ সালের নির্বাচনে ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী ঘোষণার ফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করেন নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল। এরপর নির্বাচন কমিশন ইশরাককে মেয়র পদে ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করলেও তাকে শপথ পড়ানো হয়নি। পরবর্তী তাকে মেয়র পদে শপথ না পড়ানোর জন্য উচ্চ আদালতে রিট করা হয়। আজ সেই রিট শুনানির মধ্যে দিয়েই সিদ্ধান্ত জানানো হবে।