পবিত্র ঈদুল আজহায় যখন ঘরে ঘরে খুশির আমেজ, নতুন জামা-কাপড় পরে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়া, টেবিল বাহারি খাবারে ভরপুর– ঠিক তখনই রাজধানী ঢাকার প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করছেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। তাদের কারও চোখে ক্লান্তি, কারও চোখে মেঘলা আবেগ, তবু কণ্ঠে দৃঢ়তা, তারা দায়িত্ব পালনের মধ্যেই খোঁজেন ঈদের আনন্দ।
রবিবার (৮ জুন) ঈদুল আজহার দ্বিতীয় দিনে রাজধানীর বিজয় সরণি, ধানমন্ডি, শাহবাগ, ফার্মগেট, সাইন্সল্যাব, মিরপুর, গাবতলী, উত্তরার মতো গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে ট্রাফিক পুলিশদের তৎপর দেখা যায়। দিনভর রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সড়কে কেউ হাত তুলে যান চলাচলে ইশারা করছেন, কেউ গাড়ি থামিয়ে পথচারীদের নিরাপদে রাস্তা পার করাচ্ছেন, কেউ আবার যানজট ঠেকাতে বারবার হুইসেল বাজাচ্ছেন।
ট্রাফিক কনস্টেবল মো. সাইদুর রহমান। ২০ বছর ধরে ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত। এই ঈদে পরিবারকে পাঠিয়ে দিয়েছেন গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে। নিজে থেকে গেছেন ঢাকায় দায়িত্ব পালনে। বর্তমানে তিনি তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগে দায়িত্বরত আছেন।
ট্রাফিক কনস্টেবল মো. সাইদুর রহমান বলেন, “আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। তারা ছোটবেলায় বাবার জন্য ঈদে কাঁদতো, এখন বুঝে গেছে। এখন আর কষ্ট লাগে না। আমরা যারা এই পেশায় আছি, জানি দেশের জন্য কিছু বিসর্জন দিতেই হয়। তাই এটা যেমন আমরা মানিয়ে নিয়েছি। ঠিক তেমনই পরিবারের সদস্যরা মানিয়ে নিয়েছে।”
রমনা বিভাগে ধানমন্ডির ট্রাফিক জোনে দায়িত্ব পালন করছেন সার্জেন্ট মো. ইমরান হোসেন। পুলিশের চাকরিতে আসার পর এই প্রথম ঢাকায় ঈদ করছেন পরিবার ছাড়া। দায়িত্ব পালন করছেন ধানমন্ডির রাসেল স্কয়ারে।
ইমরান হোসেন বলেন, “প্রথমে খুব খারাপ লাগছিল। বাবা-মা ছাড়া কখনও ঈদ করিনি। কিন্তু চাকরির শপথটাই এমন—যেকোনও সময়, যেকোনও অবস্থায় কাজ করতে হবে। তাই নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছি। এখন মনে হয় দায়িত্ব পালন করাটাই ঈদের বড় আনন্দ।”
ঈদের হাসি, দায়িত্বের ছায়ায় ঢাকা
তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগে দায়িত্বরত সার্জেন্ট মাসুম কায়সার। তিনি ১০ বছর ধরে এই পেশায় রয়েছেন। কায়সায় বলেন, “বাবা-মার বয়স হয়েছে। মাঝে মাঝে ভয় লাগে—পরের ঈদে তাদের পাবো তো? তবু দায়িত্ব ছেড়ে চলে যেতে পারি না। ট্রাফিক সিস্টেম ঠিক রাখা মানে অসংখ্য মানুষকে নিরাপদ রাখা। সেটা ঈদের চেয়েও বড় দায়িত্ব আমাদের।”
চোখের কোণে জল, তবু মুখে হাসি
সার্জেন্ট নূর ইসলাম জানান, “নতুনরা প্রথম দিকে কষ্ট পায়। ঈদের সকালে পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর ওদের চোখে পানি আসে। তখন আমরা সিনিয়ররা পাশে থাকি। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। তাদের বলি, ‘তোমরা আজ কাজ করছো, কাল ছুটি পাবে। এই দায়িত্ব নিয়ে একদিন গর্ব হবে।’ আমরাও তো একসময় এমনই ছিলাম।”
তিনি আরও বলেন, “আমার সন্তানরা এখন বুঝে গেছে, ঈদের দিন বাবা ডিউটিতে থাকে। ওদের মুখে যখন শুনি ‘বাবা দেশের জন্য কাজ করে’ তখন সব কষ্ট ভুলে যাই।”
পুলিশ সদস্যরা বলেন, “আমরা দেশের মধ্যেই প্রবাসী। যেমন একজন বিদেশে থেকে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারেন না, আমরাও ঢাকায় থেকে প্রিয়জন থেকে দূরে থাকি। তবে আমাদের ঈদ হয় দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে—এটাই আমাদের আত্মতৃপ্তি।”
চাকরির বাইরে মনুষ্যত্বের গল্প
ঈদের দিন এক বৃদ্ধ রাস্তা পার হতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যান বিজয় সরণিতে। এক কনস্টেবল দৌড়ে গিয়ে তাকে উঠিয়ে দেন, পানি পান করান, রিকশা এনে তুলে দেন। এমন অনেক ‘ক্ষুদ্র’ ঘটনার সাক্ষী ঈদের দিনগুলোতে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের– যা সংবাদ শিরোনাম হয় না, কিন্তু মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
ঈদের খাবারে একটু আনন্দ
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিটি ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে ঈদের দিন দায়িত্বরত সদস্যদের জন্য বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়। এ বিষয়ে তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-তেজগাঁও) তানিয়া সুলতানা বলেন, “সবাইকে তো একসঙ্গে ছুটি দেওয়া যায় না। এক ঈদে কেউ ছুটি পায়, অন্য ঈদে দায়িত্ব পালন করে। ঈদের দিনে যাতে মন খারাপ না হয়, তাই ভালো খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়। কাজের চাপ কম থাকলে আমরা কিছুটা সময় বিশ্রামও দিই।”
তিনি আরও বলেন, “ঈদের দিনে রাস্তায় কাজ করা সদস্যরা অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করেন। জনগণ যাতে নির্বিঘ্নে ঈদ উদযাপন করতে পারে, সেই ব্যবস্থাটা তারাই করেন। ওদের স্যালুট জানানো উচিত।”
পুলিশ, সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ অনেক পেশার মানুষ আছেন যাদের ঈদ হয় না পরিবারের সঙ্গে। তারা হয়তো নতুন জামা পরে না, খাঁটি সেমাই খেতে পারে না, কিন্তু তারা গড়ে তোলেন একটি সুশৃঙ্খল, নিরাপদ সমাজ। ট্রাফিক পুলিশের এই আত্মত্যাগ চুপচাপ, সবার অগোচরে এই শহরকে করে তোলে বাসযোগ্য। এই কারণেই তো বলা হয়—ঈদের চেয়ে দায়িত্ব বড়।