কাবা চত্বরে ছড়িয়ে থাকে মনুষ্যত্বের গল্প

কাবা চত্বরে সব সময় ভিড় লেগে আছে। অথচ এখানে অযাচিত কোনও কোলাহল নেই। এখানে রোদন আছে, অশ্রুজলে ভেসে যাচ্ছে শ্বেতপাথরের মেঝে, তবু কোনও চিৎকার-চেঁচামেচি নেই। আল্লাহর করুণা প্রার্থী মানুষের তসবিহ, তাহলিল, দোয়ায় গুঞ্জরিত হচ্ছে চত্বরের বাতাস, কিন্তু এখানে হাহাকার নেই। চোখে-মুখে কী এক মুগ্ধতা নিয়ে মানুষ ঘুরছে মোহগ্রস্তের মতো কাবা ঘিরে। যারা কাবাঘর ঘিরে বসে আছেন, তারাও নিভৃতে হৃদয়ে এঁকে নিচ্ছেন কাবার ভালোবাসার সিলমোহর।

মক্কার মসজিদে হারাম এক অপার্থিব ভালোবাসা নিয়ে স্থিত হয়ে আছে। মানুষ যখন এর সংস্পর্শে আসে, তখন সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার প্রেরণা পায়। মানুষের মাঝে জাগ্রত হয় মনুষ্যত্বের অনুপম চারিত্রিক উৎকর্ষ। মক্কায় আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া এমন কিছু ঘটনা উল্লেখ না করলে বিষয়টি বুঝে আসবে না।

আমরা উঠেছি হোটেলে। ফজরের নামাজ মসজিদে হারামে পড়বো বলে আমি আর আমার স্ত্রী খুব ভোরে উঠে পড়লাম। বাথরুমে যখন অজু করছি, এমন সময় রুমের দরজায় কারও টোকা দেওয়ার শব্দ শুনলাম। ভাবলাম এত সকালে কে হবে? হোটেলের লোকজন তো এত ভোরে আসার কথা নয়। অন্য রুমের কোনও হাজি সাহেব হয়তো ভুল করে আমাদের দরজায় টোকা দিয়েছেন। এমনটা হয় অনেক সময়, এটা ভেবে দরজা না খুলে অজু শেষ করলাম।

অজু শেষে যখন কাপড় পরছি, তখন আবার দরজায় টোকা পড়ল। এবার আর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমি দরজা খুললাম, দেখি এক বৃদ্ধ হাজি দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করলাম, চাচাজান, কী হয়েছে? বৃদ্ধ বললেন যে তিনি তার সঙ্গীদের খুঁজে পাচ্ছেন না। তারা তাকে রেখেই মসজিদে হারামে নামাজে চলে গেছে। এমনটা প্রায়ই ঘটে বাঙালি-ভারতীয় বা পাকিস্তানি হাজিদের ক্ষেত্রে।

লোকটি বেশ বয়স্ক। আমি তাকে বললাম, একটু অপেক্ষা করেন, আমরা এখনই বেরোচ্ছি। আমাদের সঙ্গে আপনাকে নিয়ে যাবো।

আমরা দ্রুত তৈরি হয়ে বৃদ্ধ হাজিকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে হোটেল থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। এখান থেকে মসজিদে হারামে হেঁটে যেতে মিনিট দশেক লাগে। যেতে যেতে জানতে পারলাম, তার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের মালদহে। আমাদের হোটেলে মালদহের অনেক হাজি উঠেছেন। তিনিও হয়তো তাদের সঙ্গী।

বৃদ্ধ হাজি যখন আমাদের সঙ্গে হাঁটছিলেন, খেয়াল করিনি যে তার পায়ে জুতা নেই। ইবরাহিম খলিল রোডের পিচঢালা রাস্তাটি বেশ খড়খড়ে। খালি পায়ে হাঁটা কষ্টসাধ্যই বটে। তার ওপর তিনি বৃদ্ধ মানুষ, তার নিশ্চয় আরও কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু এত মানুষের ভিড়ে তার খালি পা আমি দেখতে পাইনি।

আমাদের পাশে চলতে থাকা ভারতীয় বা পাকিস্তানি এক যুবক হাজি বিষয়টা কীভাবে যেন দেখতে পেলেন। যুবক এগিয়ে এসে নিজের পায়ের জুতা খুলে বৃদ্ধের পায়ে পরিয়ে দিলেন। বৃদ্ধ কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। যুবক কোনও প্রত্যুত্তরের আশায় না থেকে খালি পায়ে সামনে এগিয়ে গেলেন।

আরেক দিন আমি আর আমার স্ত্রী (রাবু) তাওয়াফ শেষ করে মাতাফ থেকে বের হচ্ছিলাম। মাতাফের ভেতরে সবাই জুতা পা থেকে খুলে হাতে বা ব্যাগে রাখে, নামাজের সময় পাশে রেখে নামাজ পড়ে। তাওয়াফ বা নামাজ শেষ করে জুতা হাতে নিয়ে মাতাফের বাইরে এসে তারপর জুতা পরে।

মাতাফ থেকে বের হওয়ার সময় বেশ ভিড়। আমি আর রাবু মাতাফের বাইরে এসে হাত থেকে জুতা মেঝেতে রেখে পরতে যাবো, রাবুর একটা জুতা হাতে লেগে উল্টে গেল। রাবু কাঁধের ব্যাগ গুছিয়ে নিচু হয়ে জুতা ঠিক করতে যাবে, তার আগেই এক উজবেক বা তাজিক নারী এসে তার জুতাটি ঠিক করে পায়ের সামনে দিয়ে দিলেন। রাবু তাকে নিষেধ করতে যাবে, তার আগেই তিনি কাজটি করে দিয়ে হনহন করে হেঁটে সামনে চলে গেলেন। কোনও ধন্যবাদ বা প্রশংসাবাক্য শোনার আশায় ফিরেও তাকালেন না।

মধ্যবয়সী একজন নারী, মেয়ের বয়সী একজনের জুতা ঠিক করে দিতে তার মোটেও আত্মসম্মানে বাধেনি। এখানে নিজের আমিত্বকে লীন করে দেওয়ার এমন নিবেদন আমি আর কোথাও দেখিনি।

বলছিলাম, মানুষের চারিত্রিক সৌন্দর্য অপরকে উৎসাহিত করে সচ্চরিত্রবান হতে। আপনি যদি সচ্চরিত্রবান লোকদের মাঝে থাকেন, নিশ্চিত থাকুন যে তাদের এ গুণ আপনাকেও প্রভাবিত করবে সচ্চরিত্রবান হতে। আর আপনি যদি দুশ্চরিত্র মানুষের সমাজে বসবাস করেন, কোনও না কোনোভাবে চারিত্রিক অবক্ষয় আপনাকেও প্রভাবিত করবে।

আমাদের সামনে ঘটে যাওয়া এগুলো হয়তো খুব ছোট ছোট পরোপকার, কিন্তু এগুলো অপরকে উৎসাহিত করে পরোপকার আর সৌজন্যবোধে। তার একটা উদাহরণ দিই।

আমি আর রাবু তাওয়াফ শেষ করে সাফা-মারওয়া সাঈ করছিলাম। একবার চক্কর দিয়ে এসে অনেকে সাফা বা মারওয়া প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে একটু জিরিয়ে নেন। আমরাও সাফা প্রান্তে এসে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখি, বৃদ্ধ এক ভারতীয় নারী হাজি পা ছড়িয়ে বসে আছেন। আমি ভাবলাম, হয়তো ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছেন। কিন্তু রাবু নারীর বসে থাকার ব্যাপারটা চট করে বুঝতে পারলো। সে তার পাশে গিয়ে ভাঙা হিন্দি-বাংলার মিশ্রণে বললো, পায়ে দরদ হইতেছে? টিপে দেবো?

এ কথা বলে সে হাজি সাহেবার পা টিপে দিতে লাগলো। নারীকে পায়ে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে সে বুঝে নিয়েছে তার পা ব্যথা করছে। আমিও তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম যে কোথা থেকে এসেছেন তিনি। জানালেন যে ভারতের হরিয়ানা থেকে এসেছেন ছেলের কাছে। ছেলে মক্কায় কোথাও কাজ করে। আজ মায়ের সঙ্গে আসতে পারেনি। আর তিনিও একা সাঈ করতে করতে পায়ের ব্যথায় এখন আর উঠতে পারছেন না।

রাবু কিছুক্ষণ তার পা টিপে দেওয়ার পর তিনি রাবুর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলেন।

মক্কা-মদিনায় এলে মানুষের মনুষ্যত্বের এমন ছোট ছোট সৌজন্যবোধ, পরোপকার, সৌহার্দ্য আপনাকে অভিভূত করবে। হজ-উমরাহ আমাদের এগুলোও শিক্ষা দেয়। হজ-উমরাহর এটিও একটি অন্তর্গত রহস্য। প্রত্যেক মুসলিম একে অপরের ভাই। পৃথিবীর সব প্রান্তের ভাইয়েরা যখন এই কাবাঘরের চত্বরে একত্র হবে, তখন তাদের আচরণ কেমন হবে, কেমন হবে অপর ভাইয়ের প্রতি তার ব্যবহার, সেটার বাস্তব দীক্ষা নেওয়ার কেন্দ্র এই কাবা, এই মসজিদে হারাম।

(চতুর্থ পর্ব আগামী সপ্তাহে)

ছবি: লেখক

আরও পড়ুন :

কাবার তাওয়াফ ও নিজের আত্মপরিচয়ের সন্ধান

জাবালে নুর: যে পাহাড়ে অবতীর্ণ হয়েছিল আলোর ঝরনাধারা