নাড়ির টানে, ভোটের টানে

ইফতার মাহফিল আয়োজনের মাধ্যমে ময়মনসিংহের এমপি ফাহমি গোলন্দাজ বাবেলের গণসংযোগ। নিজ নিজ এলাকায় এমন গণসংযোগ করছেন প্রতিটি দলের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীরা। ছবি-আতাউর রহমান জুয়েল

এবারের ঈদের আলাদা রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। সব ঠিকঠাক থাকলে জাতীয় নির্বাচন ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। আর বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে এখন পর্যন্ত তা নিশ্চিত। ঈদের পর নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করছে নির্বাচনের রোড ম্যাপ নিয়ে। আর রাজনৈতিক দলের আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপে এবারের ঈদ। কারণ এরপরের ঈদুল ফিতর হবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে। তাই যারা নির্বাচনে দাঁড়াতে চান, মনোনয়ন পেতে চান, জিততে চান তাদের আগাম জনসংযোগের মোক্ষম সময় এই ঈদ। তারা ঈদের টানে এলাকায় যাচ্ছে, যাচ্ছেন ভোটের টানেও।
আর শুধু ঈদ নয়, রোজার শুরু থেকেই এই কাজ শুরু করেছে রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকেই এবার তো-কর্মীদের ঈদের সময় এলাকায় থাকতে বলা হয়েছে। একই নির্দেশনা আছে বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের জন্যও। বিএনপি’র যারা এলাকায় মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন এই ঈদে তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথাও বলা হয়েছে।
রোজার শুরু থেকে ইফতার মাহফিলের পাশাপাশি ইফতার সামগ্রীও বিতরণ করা হয়েছে। আর ঈদে এলাকায় নানা আয়োজনের সঙ্গে ঈদ সামগ্রী বিতরণের খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
ঈদ সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিদিনই ইফতার পার্টির আয়োজন করেছে। বিতরণ চলছে ছোলা-মুড়ি-খেজুর-তেল-সেমাই ও কাপড়সহ বিভিন্ন ব্যবহার্য-সামগ্রীর। ইতোমধ্যেই এসব সহায়তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রচার করা হচ্ছে। এ নিয়ে কোনও কোনও নেতা সমালোচনাও করেছেন।

ময়মনসিংহের সংসদ সদস্যের আমন্ত্রণে ইফতার মাহফিলে অংশ নেওয়া এলাকাবাসী
আমাদের নেত্রকোনা প্রতিনিধি হানিফ উল্লাহ আকাশ জানান, আগামী ১১তম জাতীয় সংসদ নিবার্চনের দেড় বছর বাকি থাকলেও নেত্রকোনা জেলার ৫ টি সংসদীয় আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা বিভিন্ন কৌশলে নিজ নিজ এলাকায় নিজেদের জন-সম্পৃক্ততা ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে যাচ্ছেন। তারা তাদের নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় ঈদকে সামনে রেখে বিভিন্ন ইফতার মাহফিল, সুধী-সমাবেশ, কর্মী-সমাবেশ, সাধারণের মধ্যে ঈদ সামগ্রী বিতরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দলীয় নেতা-কর্মীসহ জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।
ফেনী সংবাদদাতা রফিকুল ইসলাম জানান, ফেনীতে তিনটি সংসদীয় আসন। এর মধ্যে ফেনী-৩ আসনটিতে সবচেয়ে বেশি তৎপরতা সম্ভাব্য প্রার্থীদের। তবে এক্ষেত্রে মহাজোটের প্রার্থীরা সক্রিয় থাকলেও বিএনপির প্রার্থীদের চোখে পড়ার মতো কার্যক্রম নেই। আওয়ামী লীগের প্রায় ১২/১৩ জন নেতা নির্বাচনকে সামনে রেখে রমজানে ইফতার মাহফিল ও ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম করে চলেছেন। ফেনী-৩ আসনজুড়েই নির্বাচনি আমেজ পুরোদমে দেখা যাচ্ছে।
জানা গেছে, ফেনীতে ইফতার ও ঈদ সামগ্রী বিতরণের মধ্যে নগদ টাকা, জাকাতের টাকা, ফিতরার টাকা, কাপড়, খাবার সামগ্রী বিতরণ চলছে। পাশাপাশি নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন আগ্রহী প্রার্থীরা।



ঈদ সামগ্রী বিতরণ করছেন খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মুনতাসির আলী। ছবি- বাংলা ট্রিবিউনফেনী জেলা প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম জানান, ফেনীতে সবচেয়ে বেশি ব্যতিক্রম এই জেলার ১ নম্বর আসনটি। এই আসন থেকেই বারবার বিএনপির এমপি নির্বাচিত হয়েছেন খালেদা জিয়া। বর্তমানে এই আসনের সংসদ সদস্য জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় নেতারা সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে অভিযোগ করেছেন।
তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে এবার জেলায় বিএনপির কোনও সাংগঠনিক তৎপরতা চোখে পড়েনি। জানা গেছে, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকার সময় এসেছেন, এমনকি রমজানে ইফতার সামগ্রী, ঈদ-সামগ্রী বিতরণ করেছেন। দলের কেন্দ্রীয় একটি টিমের আসা-যাওয়াও ছিল। কিন্তু এবার খালেদা জিয়া আসেননি, এমনকি কোনও প্রতিনিধি দলও ইফতার মাহফিল বা ইফতার সামগ্রী বিতরণ করেননি।
এলকাবাসী জানান, ফেনী সদর আসনের সাংসদ হাজি রহিমুল্লাহও রমজান মাসে তার এলাকায় নিষ্ক্রিয় রয়েছেন।



জানা গেছে, শনিবার দুপুরে সিলেটের শিবগঞ্জ এলাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ স্বেচ্ছাসেবক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামান এর পক্ষ থেকে গরীব ও অসহায় মানুষের মাঝে এ ঈদ বস্ত্র বিতরণ করা হয়।
খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মুহাম্মদ মুনতাসির আলী।  নির্বাচনি আসন সিলেটের বিশ্বনাথ। স্থানীয় দরিদ্রদের মধ্যে সহায়তা কার্যক্রম রমজানের শুরু থেকে করছিলেন তিনি। ঈদকে সামনে রেখে নিজের এলাকার লোকজনদের মধ্যে গরীবদের মধ্যে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করেছেন। এর মধ্যে কাপড়, চিনি, সেমাই, তেলসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী দিয়েছেন। মুনতাসির আলী জানান, শুধু ঈদ বা ভোটকে সামনে রেখে নয়, সাধ্যমত বরাবরই খেলাফত মজলিস সারাদেশেই ত্রাণ কার্যক্রম করে থাকে।

হবিগঞ্জের মাধবপুর-চুনারুঘাট আসনের একাধিক সংবাদকর্মী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, আওয়ামী লীগ এমপি অ্যাডভোকেট মাহবুব আলীকে হত দরিদ্রদের মধ্যে ভিজিএফ-এর সরকারি চালের বণ্টনের কর্মসূচিতে দেখা গেলেও এর বাইরে আর কিছু বিতরণ করেননি।
স্বেচ্ছাসেবকলীগ গাজীপুর মহানগর সভাপতি সঞ্জিত কুমার মল্লিকের খাদ্য সামগ্রী বিতরণ। ছবি- বাংলা ট্রিবিউনখোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা বিএনপি সভাপতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়সল আহমেদ ও তার ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান জেলা বিএনপি সহ সভাপতি শাহজাহান এবার ঈদকে সামনে রেখে নগদ টাকা, ইফতার সামগ্রী, কাপড়চোপড় বিতরণ করে এলাকায় হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নেতাকর্মীকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিএনপির এই দুই নেতার আপন বড় ভাই সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ কায়সার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কারাগারে আছেন। তাই, মানুষের সব সমালোচনা এড়াতে তাদের তৎপরতাও চোখে পড়ছে বেশি। তবে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে শাহজাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গরিবদের জন্য সহায়তা তো সব রমজানেই করে থাকি। আর এটা নির্বাচনি কোনও কর্মসূচি নয়। রোজাকে কেন্দ্র করে দান-খয়রাত আমাদের সংস্কৃতির অংশ।’
নৌকা প্রতীক নিয়ে গত নির্বাচনে অংশ নেন লক্ষ্মীপুর-১ আসনের এমপি এম এ আউয়াল। সামনের নির্বাচন নিয়ে তিনিও কাজ করছেন বলে জানান। পুরো রমজানে তিনি কয়েকবার স্থানীয় এলাকায় যাতায়াত করেছেন এবং ঈদ-সামগ্রী বিতরণ করেছেন বলে জানান আউয়াল।
এদিকে ত্রাণ সহায়তার নামে অনেক নেতা ফটোসেশন করছেন বলেও মনে করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের যুগ্ম সেক্রেটারি ইকবাল সিদ্দিকী। তিনি বলেন, একটা কাপড় কিংবা এক প্যাকেট সেমাই ৫/৬ জন মিলে একজনকে দিচ্ছেন শুধুই ছবি তোলার জন্য!

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জান্নাতুর রহমানের ঈদ সামগ্রী বিতরণ। ছবি- বাংলা ট্রিবিউনসাতক্ষীরা প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান সরদার জানিয়েছেন, সাতক্ষীরা-৪ (শ্যামনগর-কালিগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য এসএম জগলুল হায়দার এরই মধ্যে তার নির্বাচনি এলাকায় দুস্থদের মাঝে শাড়ি-কাপড়, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি ও ঈদ সামগ্রী বিতরণ করেছেন।
সাতক্ষীরা সদর- ২ আসনের এমপি মীর মোস্তাক রবি তার নির্বাচনি গণসংযোগের অংশ হিসেবে রমজান মাসে বেশ কয়েকটা ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেন। এছাড়া তিনি দুস্থদের মাঝে বিভিন্ন ঈদ সামগ্রী বিতরণ করেন।  একই ধরনের কর্মসূচিতে দেখা গেছে আশাশুনি - কালিগঞ্জ আসনের (মাতক্ষীরা-৩) এমপি আফম রুহুল হককেও।
একই জেলার তালা-কলারোয়া (সাতক্ষীরা-১) আসনের এমপি মুস্তাফা লুৎফুল্লাহর স্ত্রী নাসরিন খান লিপিও এলাকায় এসে বেশ কিছু ইফতার মাহমিলে অংশ নেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংসদ চলার কারণে এলাকায় কম ছিলাম, তারপর এসে বেশ কয়েকটি ইফতার মাহফিলে অংশ নিয়েছি।
সিলেট এমসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিএনপির ঈদ বস্ত্র বিতরণ। ছবি- বাংলা ট্রিবিউনঈদ ও রোজাকে ঘিরে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের এই তৎপরতার পেছনে দলীয় কোনও নির্দেশনা আছে কিনা তা জানতে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, সর্বশেষ সংসদীয় দলের বৈঠকে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সংসদ সদস্য ও নির্বাচনে ইচ্ছুক এমন দলীয় নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে গণসংযোগসহ এলাকাবাসীর সঙ্গে কুশল বিনিময়ের নির্দেশ দেন। এছাড়াও দলীয় সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, প্রতিটি সংসদীয় এলাকা থেকে তৃণমূল পর্যায়ে তিন জন করে প্রার্থী বাছাই করবে আওয়ামী লীগ। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন এবং স্থানীয় পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে দলীয়ভাবেও তাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়া হবে। এ কারণে দলের হয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশী সব নেতা এই ঈদে গণসংযোগের জন্য ছুটছেন নিজ নিজ এলাকায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও দলীয় মুখপাত্র ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমি সবসময় আমার এলাকায় ঈদ করি। এবারও ঈদ করার জন্য আমি আমার নির্বাচনি এলাকায় অবস্থান করছি। আমাদের দলীয় সভাপতির আগেই নির্দেশনা রয়েছে যার যার এলাকায় যাওয়া, এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ত হওয়া। তবে ঈদ উপলক্ষে আলাদা করে কিছু বলা হয়নি।’
অন্যদিকে, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন জানান, ঈদকে সামনে রেখে স্থানীয় এলাকায় তিনি মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সাধ্যমতো সহায়তা দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনকে সামনে রেখে না হলেও সাধারণত যে কোনও উৎসব এবং ঈদের সময় দলের একটা নির্দেশনা থাকে। নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, এবং বিশেষ করে গত সাত-আট বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি করতে গিয়ে যেসব নেতা-কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের সঙ্গে দেখা করা, তাদের পরিবারের পাশে থাকার ব্যাপারে একটা নির্দেশনা দল থেকে দেওয়া আছে। একারণে নেতা-কর্মীরা সবাই যার যার এলাকায় যাচ্ছেন।’  

/এসটিএস/ইএইচএস/টিএন/