চার রাজনীতিক দম্পতির ঈদের গল্প

রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে পরিচয়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের নৈকট্যবোধ থেকে পরস্পরের কাছাকাছি আসা। সেখান থেকে পরিণয়। এমনই চার রাজনীতিক দম্পতি ঈদুল ফিতর উপলক্ষে তাদের রাজনীতি আর সংসার জীবনের গল্প বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনকে। তাদের দাবি, স্বামী-স্ত্রী উভয়েই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলে অসুবিধার চেয়ে সুবিধা বেশি। এতে দুই জনের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ভালো হয়। রাজনৈতিক কাজেই পরস্পরের কাছাকাছি থাকা যায় বলে আলাদা করে একে অপরকে সময় দেওয়ার অপরিহার্যতা কম থাকে।

noname

অসীম–অপুর সম্পর্কের নেপথ্যে ওবায়দুল কাদের 

আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সংসদ সদস্য (নেত্রকোনা-৩) অসীম কুমার উকিল তার স্ত্রী যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিলের সঙ্গে সংসার করছেন ২৬ বছর ধরে। ছাত্রলীগের রাজনীতি করা অবস্থায় তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৯৩ সালে বিয়ে করেন। বড় ছেলে শায়ক উকিল যুক্তরাষ্ট্রে আর ছোটছেলে শুদ্ধ উকিল কানাডায় পড়ালেখা করছেন।

রাজপথে মিটিং-মিছিল করতে গিয়ে অপুর সঙ্গে অসীমের সঙ্গে পরিচয়। অপু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘(১৯৮৯-১৯৯৩) কমিটিতে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অসীম। তখন আমি বদরুন্নেসা কলেজ শাখার সভাপতি।  সম্পর্ক শুরুটা তখনই। অনার্স প্রথম বর্ষে পড়া অবস্থায় একদিন কাদের ভাই (ওবায়দুল কাদের) বলেন- আমি তোমার বিয়ের পাত্র ঠিক করে ফেলেছি। হিন্দু মেয়েরা এমনিতে রাজনীতিতে আসেই না, আসলেও বেশিরভাগই বিয়ের পরে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যায়। কিন্তু আমি চাই তুমি রাজনীতিতে থাকো। সেজন্য একজন রাজনীতিবিদ ছেলে ঠিক করেছি।’

অপু  জানান, ওবায়দুল কাদের একইরকম কথা অসীমকেও বলেছিলেন। ‘আমি তোমার জন্য পাত্রী ঠিক করে রেখেছি। অনেক সময় স্ত্রীরা রাজনীতি করতে দিতে চায় না। তাই আমি এই রাজনীতিবিদ মেয়েটিকে ঠিক করেছি তোমার জন্য।’ বলেছিলেন কাদের। আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক এই জুটির বিয়ে নিয়ে প্রথম অপুর বাবা-মামার সঙ্গে কথা বলেন। অপু বলেন, ‘এরপর তিনি ও কাদের ভাই আমার শ্বশুর বাড়ির লোজজনের সঙ্গে কথা বলেন। পরে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয়।’

noname

এবার ঈদের দিনে ঢাকাতেই থাকবেন অপু-অসীম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশে থাকায় তার পরিবর্তে শুভেচ্ছা বিনিয়ম করবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। অপু বলেন, ‘ঈদের দিন আমরা দুইজনেই ওবায়দুল কাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে যাবো। এরপর একসঙ্গে গ্রামের বাড়িতে যাবো। সেখানে ২-৩ দিন স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করবো। দুই জনের নেতাকর্মীও এক। ফলে সেখানেও শুভেচ্ছা বিনিময়ে হয়তো একসঙ্গে থাকা হবে।’

অপু বলেন, ‘দুইজনেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে যে কোনও অনুষ্ঠানে একসঙ্গে যেতে পারি। এভাবে  রাজনীতির পাশাপাশি একে অপরকেও সময় দেওয়াও হয়ে যায়। দুই ভিন্ন পেশায় থাকলে হয়তো এই সুবিধাটা পাওয়া কঠিন হতো।’ 

যেভাবে প্রকাশ পায় খোকন-শিরিনের প্রেম

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খাইরুল কবির খোকন ও স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক শিরিন সুলতানার দাম্পত্য জীবন ২৭ বছরের। প্রেম করেই বিয়ে করেন তারা। নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে খোকন বাংলা ট্রিবিউন জানান, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শুরুর দিনগুলোতে তাদের পরিচয়। শিরিন তখন ইডেন কলেজের ছাত্রী।  একসঙ্গে মিটিং-মিছিল করতে করতেই তাদের সম্পর্ক ভালোবাসায় মোড় নেয়। খোকন-শিরিন দম্পতির একমাত্র ছেলে কানাড়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।

খোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর ‘মিস্টার খোকন ও মিসেস খোকন’ নামে বঙ্গভবন থেকে দুইটি আমন্ত্রণপত্র পাই। তখন শিরিনকে সারপ্রাইজ দিতে ‘মিসেস খোকন’ হিসেবে বঙ্গভবনে তাকে নিয়ে যাই। যদিও তখন সেই জানতো না কি পরিচয়ে বঙ্গভবনে এসেছিল। পরে আমাদের এক নেতা তার কাছে জানতে চায়- কোন পরিচয়ে, কার সঙ্গে এসেছো। উত্তর শিরিন বলে, আমি খোকন ভাইয়ের সঙ্গে এসেছি। তখন ওই নেতা তাকে বলেন, না তুমি হলের ভিপি হিসেবে নয়, মিসেস খোকন হিসেবে বঙ্গভবনে এসেছো। এরপর সবাই জানতে পারে আমাদের সম্পর্কের কথা।”

noname

১৯৯২ সালের ৮ই মে শিরিনকে বিয়ে করেন খোকন। শুরুতে তাদের পরিবারের সদস্যরা বিয়েতে রাজি না থাকলেও এক পর্যায়ে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ অন্যান্য নেতাদের মাধ্যমে দুই পরিবারকে তাদের বিয়ের জন্য রাজি করানো হয়। নির্বাচনী এলাকা নরসিংদীতে নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করে ২-৩ দিন পরে ঢাকায় ফিরবেন এই দম্পতি। খোকন মনে করেন, স্বামী-স্ত্রী দুই জনই রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়াতে সুবিধা হয়। বলেন, ‘যেমন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া কারাগারে আগে তার ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে একসঙ্গেই যেতাম আমরা। রাতে দেরি করে বাসায় ফিরলেও কোন সমস্যা হয় না। কারণ সে জানে কী কারণে দেরি হয়েছে। দুই জনের পেশা এক হওয়ার কারণেই এই সুবিধা। শিরিনও একই সুবিধা পেয়ে থাকে।’

রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাই সাকি-তাসলিমার পরিবার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র ফেড়ারেশনের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন জোনায়েদ সাকি ও তার স্ত্রী তাসলিমা আক্তার। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ককারী সাকি আর বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সমন্বয়ক তাসলিমা বিয়ে করেন ২০০০ সালে। তাদের কোনও সন্তান নেই। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাই তাদের কাছে পরিবারের মত।

এবারের ঈদে এই রাজনৈতিক জুটি ঢাকাতেই থাকবেন। তাসলিমা জানান, আগে ঈদে বন্ধু-বান্ধবদের সময় কাটাতেন। বাবা বেঁচে ছিলেন যখন, তখন তাকে সময় দিতেন। এখন ঈদের সকালে মা-ভাই-বোন আর নেতাকর্মীদের সময়  দেন। ‘মা-বাবা, ভাই-বোনদের চেয়েও নেতাকর্মীরাই সবচেয়ে বড় পরিবার। ফলে যেসব নেতাকর্মীরা ঢাকায় থাকে তাদের সঙ্গে ঈদের দিন সন্ধ্যায় আড্ডা হয়। আগে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় শাহবাগে আড্ডা হতো। এখনও অনেকে থাকে না। কেউ থাকলে সন্ধ্যার পরে আড্ডা হয়।’ বলেন তসলিমা। গত ২ টি ঈদে সাভার রানা প্লাজার ভবন ধসে আহতদের সঙ্গে সেখানে কাটিয়েছন তিনি।

noname

জোনায়েদ সাকি জানান, স্থানীয় মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করে মায়ের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর সারাদিনই নেতাকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটে।           

ঈদের সব অনুষ্ঠানে দেলোয়ার-লিলি থাকবেন একসঙ্গেই

আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ও যুবলীগের সহ-সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলির পরিচয় ছাত্রলীগের রাজনীতি করতে গিয়ে। তাদের প্রেমের সম্পর্ক বিয়েতে গড়ায় ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল। একমাত্র সন্তান সোহাদ্য সায়ান নিয়ে ঢাকাতেই এবারের ঈদ উদযাপন করবেন তারা।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঈদের সকালে পরিবারকে নিয়ে আওয়ামী লীগের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে যাবো। সারাদিন বাসায় নেতাকর্মীরা আসবে, তাদেরকেও সময় দেবো। রাতে কোনও একটা সময় ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার চিন্তা আছে। ঈদের পরে গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে যেতে পারি।’

noname

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা দুই জনেই রাজনীতিবিদ হওয়ার কারণে ঈদে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা বিনিয়ম অনুষ্ঠানে একসঙ্গেই যায়। শুধু তাই নয় যে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও একসঙ্গে যেতে পারি আমরা। এটাই আমাদের বড় সুবিধা।’