মসজিদের ইমাম ছিলেন যশোরের মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস। এরশাদের কল্যাণে তার সরকারের ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। তবে এরশাদের পতনের পর পর জমিয়তে উলামায় ইসলামে যোগ দেন মুফতি ওয়াক্কাস। বর্তমানে তিনি এই দলের একাংশের চেয়ারম্যান। মুফতি ওয়াক্কাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত এরশাদের সঙ্গে ছিলাম। আমি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জয়ী হওয়ার পরে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করি। কিন্তু আমার মূল দল ছিল জমিয়তে ইসলাম। পরে আবারও সেই দলে ফিরে আসি।’
একাদশ সংসদ নির্বাচনেও জোটগতভাবে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন এরশাদ। সেই জোটে গত বছরের ১১ আগস্ট শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস যোগ দেয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টির সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতা করে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। তবে সেই জোটের অস্তিত্বও এখন আর নেই।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, ‘এরশাদের সঙ্গে জোটে গিয়েছিলাম নির্বাচনের জন্য। নির্বাচন শেষে এ জোটের কোনও কার্যকারিতা আর নেই।’
মাহফুজুল হক বলেন, ‘এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেছিলেন। শুক্রবার জুমার নামাজের দিনে ছুটি, মসজিদ নির্মাণসহ অনেক কিছু করেছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে ইসলামি দলগুলোর অনেকেরই এরশাদের প্রতি আগ্রহ ছিল। কিন্তু এরশাদের মধ্যে অস্থিরতা ছিল। সকাল-বিকাল দ্রুত সিদ্ধান্ত বদলাতেন তিনি। এসব কারণে তার প্রতি আস্থা থাকেনি। আগ্রহ থাকলেও ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে এরশাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।’
‘আমার কর্ম আমার জীবন’ শীর্ষক বইয়ে এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা প্রসঙ্গে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। সেখানে প্রায় ছয় পৃষ্ঠাজুড়ে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও অষ্টম সংশোধনী বিল পাস’ শিরোনামে লিখেছেন এরশাদ। বইয়ে তিনি বলেছেন—‘আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমাদের সমাজের অবক্ষয় রোধ করতে হলে, আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের সত্যিকারের মুসলমান হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, ইসলামকে আমাদের সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, সংবিধান থেকে শুরু করে সব জায়গায়। ইসলাম শুধু মুসলমানদের জন্যই যে কল্যাণকর, তা নয়। এ সত্যের আলোকেই আমি ও আমার সরকার রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার পদক্ষেপ নিই।’
বায়তুল মোকাররম মসজিদকে ‘জাতীয় মসজিদ’ হিসেবে ঘোষণা করেন এরশাদ। ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি দেশের বিভিন্ন মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যেতেন। নতুন মসজিদ নির্মাণ ও বিভিন্ন মসজিদের ব্যাপক সংস্কার কাজ করা হয় তার আমলে। ১৯৮৩ সালের ১৪ জানুয়ারি এক সম্মেলনে দেশের সব মসজিদের বিদ্যুৎ ও পানির বিল মওকুফের ঘোষণা দেন তিনি। ১৯৮৫ সালে আলিয়া মাদ্রাসার দাখিলকে এসএসসি এবং ১৯৮৭ সালে আলিম’কে এইচএসসির সমমান ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও বেতারে নামাজের আগে আজান প্রচার করা শুরু হয় এরশাদের আমল থেকে। আগে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল। এরশাদের শাসন আমলে এসএসসি পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ফরিদপুরে আটরশীর দরবার ও পিরোজপুরে শর্শিনা দরবার শরিফে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। যদিও এই দুই দরবার বরাবরই বিতর্কিত। প্রসঙ্গত, শর্শিনা দরবার শরিফের গদিনশিন পীর মাওলানা শাহ আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী। মুক্তিযুদ্ধের সময় শর্শিনার দরবার, মাদ্রাসা রাজাকার ও আলবদরদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার হতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে গ্রেফতার হয়েছিলেন আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ। পরে তৎকালীন সরকারের সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান শর্শিনার পীর।
অন্যদিকে, ফরিদপুরের সদরপুরে আটরশী বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের প্রতিষ্ঠাতা ও পীর ছিলেন শাহ সুফি হাশমত উল্লাহ। এই জাকের মঞ্জিল নিয়েও বরাবর আপত্তি ছিল কওমিপন্থী আলেমদের।
এ প্রসঙ্গে মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, ‘আটরশী দরবার শরিফে এরশাদ যেতেন, এটা আলেমদের অপছন্দনীয় ছিল। এছাড়া, এরশাদ নিজে আলেমদের কখনও গুরুত্ব দিয়ে ডাকেননি। আলেমদের পরামর্শ নিয়ে কোনও কিছু করার চেষ্টাও করেননি।’
‘আমার কর্ম আমার জীবন’ শীর্ষক বইয়ে এরশাদ লিখেছেন, ‘আমার নিয়মিত কর্মসূচির মধ্যে ঢাকা শহরের মসজিদ পরিদর্শনই শুধু অন্তর্ভুক্ত ছিল না, দায়িত্ব পালনের দীর্ঘ ৯ বছর আমি ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানেও একটির পর একটি মসজিদ পরিদর্শন করি এবং জনগণের সঙ্গে জুমার নামাজ আদায়ে শরিক হই। ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় আমার উদ্যোগ অনেকের কাছে ভালো লাগেনি। কেউ কেউ আমাকে গোঁড়া মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত করারও চেষ্টা করলেন। কেউ কেউ বললেন, আমি ধর্মকে অবলম্বন করে রাজনীতি করছি। কিন্তু আমি জানি এবং আমার মতো আরও অনেকে এটা বিশ্বাস করেন যে, নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা গোঁড়ামি নয়, ধর্মভীরুতা।’
আব্দুল লতিফ নেজামী বলেন, ‘কোন দৃষ্টিকোণ থেকে কে কীভাবে দেখছে, সেটার ওপরে নির্ভর করে অনেক কিছু। এরশাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বির্তক ছিল, প্রশংসাও কেউ কেউ করেছেন। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। তাই সব কাজকর্ম ও আলাপ-আলোচনায় ধর্ম চলে আসে। জনপ্রিয় থাকতে হলে জনগণের ধর্মবিশ্বাসকেও মূল্যায়ন করতে হয়। এ কারণে শুধু এরশাদ নন, প্রায় প্রতিটি দলই ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছেন। প্রায় সব দলের নেতারা ভোটের আগে বিভিন্ন মাজারে গিয়েছেন।’
এরশাদের ধর্ম চর্চা ও রাজনীতিতে ধর্মের প্রয়োগ বিষয়ে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ হলো অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্ম নিরপেক্ষ। সেই রাষ্ট্রের ধর্মকে ইসলাম করেছেন এরশাদ। এটা এমন একটা স্পর্শকাতর বিষয় যে, এটাকে বদলানো খুব কঠিন। এমনকি আওয়ামী লীগও রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার কারণে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সংশোধন করেছে এবং একইসঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা করেছে। এখন সংবিধান স্ববিরোধী দলিলে পরিণত হয়েছে।’
আরও পড়ুন:
‘জাতীয় ইসলামি মহাজোট’ এর আত্মপ্রকাশ
এরশাদের মৃত্যুতে ইসলামি দলগুলোর শোক
মঙ্গলবার শেষবারের মতো রংপুর নেওয়া হবে এরশাদকে