এমপি-মন্ত্রীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড পিছু ছাড়ছে না ক্ষমতাসীন আ.লীগের

এমপি-মন্ত্রীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড পিছু ছাড়ছে না ক্ষমতাসীন আ.লীগকেদলীয় এমপি-মন্ত্রীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড পিছু ছাড়ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে। দলের কোনও এমপি বা মন্ত্রীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের রেশ না কাটতেই অন্য একজন একই ধরনের ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন। দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ধারাবাহিক এসব কর্মকাণ্ড ভাবমূর্তি নষ্ট করছে সরকারের আর দলকে ফেলছেন ইমেজ সংকটে।
সরকার দলের কয়েকজন নেতা ও এমপিরা হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, এসব কর্মকাণ্ডে সরকারের অগ্রযাত্রাকে ম্লান করে দিচ্ছেন কতিপয় ব্যক্তি। সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করার অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে বিরোধী দলগুলোকে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চলতি মেয়াদের দুই বছরের সময়কালের ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অন্তত দুই ডজন মন্ত্রী-এমপি বিভিন্ন ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে সরকার ও দলকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন। সর্বশেষ দলীয় এমপি আবদুল লতিফ কম্পিউটার প্রোগ্রামের ফটোশপের মাধ্যমে ‘নিজের শরীরের অংশের’ সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মুখমণ্ডল লাগিয়ে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। খোদ আওয়ামী লীগ থেকেই এহেন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ উঠেছে। ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ওই এমপির বিরুদ্ধে মানহানির মামলাও দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ফারুক আহমেদকে হত্যার অভিযোগে টাঙ্গাইল ৩ আসনের সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানার বিরুদ্ধে বুধবারের পুলিশি চার্জশিট আওয়ামী লীগ ও সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ফেলেছে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারের ঘটনায় দলের স্থানীয় সংসদ সদস্যের নেপথ্যে ভূমিকা পালনের অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এমপির মেয়ের জামাই লে. কর্নেল (বরখাস্ত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। লে. কর্নেল (বরখাস্ত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ তখন র‌্যাব-১১ এর সিও’র (অধিনায়ক) দায়িত্বে ছিলেন। এ ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াও এ ঘটনায় দলের ভেতরে এবং সরকারে বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এদিকে গত বছরের মাঝামাঝি সময় উচ্চ আদালতে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জরুরি অবস্থার সরকারের সময়কালে দুর্নীতি মামলার ১৩ বছরের সাজা বহাল নিয়ে শোরগোল দেখা দেয়। পরে অবশ্য আপিল বিভাগ থেকে ওই রায় স্থগিত করে দেওয়ায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে।

ধর্ম ও তাবলিগ জামায়াত নিয়ে করা দলের সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্য গত দুই বছরে সরকারকে সব থেকে বেশি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। ওই ঘটনার জের ধরে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। পরে দল ও মন্ত্রিসভা থেকে তাকে বহিষ্কারের পাশাপাশি তার সংসদ সদস্য পদ বাতিলের জন্য স্পিকারের কাছে চিঠি দেওয়া হয়। পরে অবশ্য তিনি নিজেই সংসদ সদস্য পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। ঘটনার জের ধরে লতিফ সিদ্দিকীকে এর আগে জেলেও যেতে হয়। বর্তমানে সাবেক একই সংসদ সদস্য রাজনীতি থেকে অনেকটা নির্বাসনে জীবনযাপন করছেন।

গত বছরের শেষ দিকে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। গাইবান্ধা-১ আসনের এই সংসদ সদস্য তার নিজের পিস্তলের ছোড়া গুলি লাগে চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রের পায়ে। বিষয়টি নিয়ে সারাদেশে সমালোচলার ঝড় ওঠে। ঘটনার পর এই সংসদ সদস্যের নামে মামলা দায়ের করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই সংসদ সদস্য গ্রেফতারও হন। পরে ‍অধিবেশনে যোগ দেওয়ার শর্তে মাস খানেক পর মুক্তি পান তিনি।

বর্তমান সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের মধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে সরকারকে কয়েক দফায় বিব্রত হতে হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর ভূমিকার কারণে জাতীয় বেতন স্কেল নিয়েও সরকার সমালোচনার মুখে পড়ে। সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের দ্বিগুণেরও বেশি বেতন বাড়ালেও অর্থমন্ত্রীর দু-একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে সরকার প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারীদের খুশি করতে পারেননি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন ও সেশন ফি’র ওপরে ভ্যাট আরোপ করেও তুমুল সমালোচিত হন তিনি। এছাড়া ভয়ভীতি দেখিয়ে হিন্দুদের সম্পত্তি কম দামে কেনার অভিযোগে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, পঁচা গম ক্রয়ের অভিযোগে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সরকারি কর্মকর্তাকে হুমকি ও অস্ত্রসহ উত্তরার একটি বাড়িতে হামলা চালাতে গিয়ে যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয় এবং স্কুল বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘক্ষণ রাজপথে দাঁড়িয়ে রেখে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর শাহরিয়ার আলম সরকারকে বিতর্কিত করেছেন। এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য কক্সবাজার-৪ আসনের আবদুর রহমান বদি, চাঁপাইনবাবঞ্জ-১ আসনের গোলাম রব্বানী, রাজশাহী-৪ আসনের মো. এনামুল হক, ফেনী-২ আসনের নিজাম উদ্দিন হাজারী, পটুয়াখালী-২ আসনের সদস্য চিফ হুইপ আসম ফিরোজ, পটুয়াখালী-৪ আসনের মাহবুবুর রহমান, পিরোজপুর-১ আসনের একেএমএ আউয়াল, ভোলা-৩ আসনের নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সিলেট-৩ আসনের মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য পিনু খান, ঢাকা-১৬ আসনের ইলিয়াস মোল্লা, দিনাজপুর-২ আসনের তাহজিব আলম সিদ্দিকী নীলফামারী-৩ আসনের গোলাম মোস্তফা, খুলনা-৬ আসনের অ্যাডভোকেট নুরুল হকসহ বেশ কয়েকজন এমপি বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য সদস্য বলেন, প্রধানমন্ত্রী সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে যখন দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছেন, তখন দলের কিছু ব্যক্তি বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর এসব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছেন।

এই সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বর্তমানে তাদের দলের ভাব আছে কিন্তু মূর্তি নেই।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন বলেছেন, আমরা বলি না আমাদের দলের সবাই ফেরেশতা। সমাজের নিয়মেই এসব ঘটছে। সমাজে যেমন ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎ ‍মানুষ রয়েছে। আওয়ামী লীগও তার বাইরে নয়। লোভ-লালসার কারণেই এসব হয়তো হচ্ছে।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ভেতরে কিছু দুষ্কৃতকারী বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাদের উপড়ে ফেলতে হবে। এই বিষফোঁড়ার দায় আওয়ামী লীগ নেবে না। তিনি বলেন, যারাই অপরাধ করুক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমাদের দলে যারা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছেন, তাদের স্থান আর দলে থাকবে না।

কতিপয় এমপি ও মন্ত্রীর কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন সময়ে দলের ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে স্বীকার করেন সরকার দলীয় সদস্য ও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, যখনই কোনও সংসদ সদস্য বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ান দল হিসেবে আমরা বিব্রতবোধ করি। তবে আওয়ামী লীগ কাউকেই প্রশ্রয় দেয় না। লতিফ সিদ্দিকী, মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন সর্বশেষ আমানুর রহমান রানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে তার প্রমাণ দিয়েছে দল।

দলীয় সব জনপ্রতিনিধিদের জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা ও দলের ভাবমূর্তি বিষয়টি বিবেচনা করে কাজ করার পরামর্শ দেন দলের এই নেতা।

/এএইচ/এপিএইচ/