তবে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘শর্তহীন প্যারোলে মুক্তি হলে খালেদা জিয়া রাজি হতে পারেন।’
বিএনপি খুঁজছে তৃতীয় পক্ষ
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র মনে করছে, মুজিববর্ষ উদযাপনকে সর্বজনীন রাখতে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। তবে, রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে খালেদা জিয়ার কাছ থেকে প্যারোলের আবেদন চায় সরকার। আর এই চাওয়া পূর্ণ করতে বিএনপির মধ্যেও দুই ধরনের চিন্তা রয়েছে। দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে যেকোনও মূল্যে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও স্বয়ং নেত্রীর স্পষ্ট মনোভাব তারা জানতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে দলের সিনিয়র নেতারা আবারও প্রিজন সেলে সাক্ষাতের আবেদন করতে পারেন। আবার কোনও কোনও নেতা মনে করছেন, খালেদা জিয়াকেই প্যারোলের আবেদনের জন্য রাজি করাতে হবে। আর এজন্য দলেরই বিশ্বস্ত কোনও নেতাকে দায়িত্ব দিতে হবে।
তবে, দায়িত্বশীল সূত্রটি জানায়, সরাসরি প্যারোলে মুক্তি চেয়ে আবেদন করবেন না খালেদা জিয়া। আবার সরকারও তাকে প্যারোলের বাইরে ছাড়তে নারাজ। সেক্ষেত্রে পুরো বিষয়টি মিটমাট করতে উভয়পক্ষের মধ্যে একটি তৃতীয় পক্ষ খুব জরুরি। এই পক্ষকে আশ্বস্ত করতে হবে, ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে আগেও জানিয়েছেন, সরকারের মনোভাব জানা ছাড়া জামিন কিংবা প্যারোলে মুক্তি—কোনও উদ্যোগই সফল হবে না। খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কোনও ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলা যাবে না—এমন অবস্থানের কারণেই নেতারা সমঝোতার পথে হাঁটতে চেয়েছেন। তবে, দৃশ্যমান রাজনৈতিক কৌশল অক্ষুণ্ন থাকে, এমন উদ্যোগই নেওয়ার পক্ষে বিএনপি নেতারা।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, শিগগিরই জামিনের আবেদন করা হবে। সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) রাতে দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য আবারও হাইকোর্টে আবেদন করা হবে। এক বেঞ্চে না হলে অন্য বেঞ্চে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মনোভাব জানতে হবে। আমরা জামিনের আবেদন করবো। দলের মধ্যে বিভিন্ন রকমের আলোচনা আছে। তবে, কোনও সিদ্ধান্ত নেই।’
বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তৃতীয় কোনও পক্ষ বিষয়টির সমাধান করবে, এটা বিএনপি ভাবতে পারে। কিন্তু তারা তো এটা বলে না যে আমরাও তো সাক্ষাৎ করতে চেয়েছি, কিন্তু বিএনপি তো কোনও উদ্যোগ নেয়নি। প্রথম দফায় সরকারই অনুমতি দেয়নি।’
ফ্রন্টের সূত্র জানায়, গত অক্টোবরে ফ্রন্টের নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চায়। পরে সাক্ষাৎ চেয়ে দরখাস্তও করা হয়। একপর্যায়ে ওই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।
ফ্রন্টের প্রভাবশালী একজন সদস্য বলেন, ‘বিএনপির উচ্চপর্যায়ে একাধিকবার বলা হয়েছে, প্রয়োজনে আমরা আবার সাক্ষাৎ করতে যাই। খালেদা জিয়াকে কনভিন্স করি, কিন্তু বিএনপি রাজি হয়নি। এখন জামিনের প্রক্রিয়াটি নিয়েও সুযোগ এসেছে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্না, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনসহ কামাল হোসেনকে জামিন আবেদনে যুক্ত করার বিষয়টি চিন্তা করা যেতে পারে।’
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তির আবেদনে সায় দেবেন বলে মনে করি না। নিঃশর্ত প্যারোল হলে তিনি দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যেতে পারেন।’
আওয়ামী লীগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, মুজিববর্ষ ও স্বাস্থ্যের দিকটি বিবেচনায় সরকারের উচ্চপর্যায় খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক। সেক্ষেত্রে অবশ্যই প্যারোলে মুক্তি চাইতে হবে বিএনপি চেয়ারপারসনের দিক থেকে। আর এর সম্ভাবনাও অনেক ক্ষীণ বলেও মনে করছে সূত্রটি।
খালেদা জিয়ার ‘জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা, মনোভাব ভালো’
খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল বোর্ডে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জিলন মিয়া সরকার। গত শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) তিনি ও পারিবারিক দুই চিকিৎসক খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নিতে প্রিজন সেলে যান। এর দুই দিন পর সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) মেডিক্যাল বোর্ডের সব সদস্যসহ আরও দুজন চিকিৎসক বিএনপি চেয়ারপারসনকে দেখতে যান।
অধ্যাপক ডা. জিলন মিয়া সরকার সোমবার সন্ধ্যায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আজ মেডিক্যাল টিমে বাত, ডায়াবেটিস, অর্থোপেডিকস, ফিজিওথেরাপি, কার্ডিওলজি ও বক্ষব্যাধির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা খালেদা জিয়াকে দেখে এসেছেন।’
ডা. জিলন মিয়া বলেন, ‘গত শনিবার আমি ও তার পরিবারের দুজন চিকিৎসক বিএনপি চেয়ারপারসনকে দেখতে গিয়েছিলাম। আগের মতোই আছে তার স্বাস্থ্য। জয়েন্টের ব্যথাগুলো একটু বেশি। এক বছর আগেও এ রকমই ছিল, ভর্তির দিন যেমন ছিলেন, শনিবার দেখলাম তেমনই আছেন।’
সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) পুরো মেডিক্যাল টিম খালেদা জিয়াকে দেখতে যায় বলে জানান ডা. জিলন মিয়া। তিনি বলেন, ‘আজও আমরা সব সদস্য খালেদা জিয়াকে দেখে এসেছি। জয়েন্টের জন্যই কষ্ট বেশি। জয়েন্টগুলো একটু ডিফর্ম হয়ে গেছে। ব্যথাও বেশি, খুব আস্তে-আস্তে হাঁটতে হয়।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের মনোভাব কেমন—এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. জিলন মিয়া বলেন, ‘মনোভাব খুব ভালো। সবদিক দিয়েই ভালো। এতদিন আছেন, তারপর জয়েন্টের ব্যথাগুলোই বেশি।’
উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার সম্মতির ভিত্তিতে তাকে অধিকতর চিকিৎসা (অ্যাডভান্স বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট) করানোর নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।
খালেদা জিয়া এই চিকিৎসা নিচ্ছেন না কেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে জিলন মিয়া বলেন, ‘তিনি নিচ্ছেন না, কারণ সাইড ইফেক্ট কিছু আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি একা, পরিবার-পরিজন, স্বজন ছাড়া এই এমন একটা স্পেশাল ওষুধ দেবো। তাকে বোঝানো হয়েছে, তিনি তৈরি থাকলে দেবো। যেকোনও সময় শুরু করবো। অনেক সপ্তাহই চলে গেলো।’
মেডিক্যাল বোর্ডের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, খালেদা জিয়াকে বাতের চিকিৎসায় সর্বাধুনিক পদ্ধতির ট্রিটমেন্ট দেওয়ার জন্য কাউন্সেলিং করানো হলেও তিনি মত দিচ্ছেন না।
নতুন করে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা জানিয়ে জিলন মিয়া বলেন, ‘কিছু পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়েছে, কিছু ওষুধ দেওয়া হয়েছে। তিনি পরীক্ষা বেশি করতে চান না। তিনি বাইরের একজনকে দিয়ে পরীক্ষা করান।’ আবার সব পরীক্ষা করবেন বলেও তিনি জানান।