শুক্রবার শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশের পর শনিবার অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সংঘাতে জড়ালো বিএনপি। পুলিশের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাজধানীর কয়েকটি প্রবেশমুখে ঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে দলের কর্মীরা। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় যাত্রাবাড়ি থানার সাইনবোর্ড এলাকা। ঘটনায় বিএনপির দুই জন সিনিয়র নেতাসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এ সময় ৯০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কয়েকটি স্থানে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। কর্মসূচি চলাকালে সাভারের আমিন বাজারে ককটেল বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়।
এদিকে পুলিশের নিষেধাজ্ঞায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করলেও শনিবার রাজধানীতে তাদের সক্রিয় দেখা গেছে। সতর্ক অবস্থানের নামে দলটির কর্মীরা বেশ কয়েকটি স্থানে জড়ো হয়। কয়েকটি স্থানে তারা রাজপথে মিছিলও করেছে। এ সময় তাদের হাতে লাঠিসোঁটাও দেখা গেছে। এদিকে শনিবারের সংঘাতের ঘটনার জন্য বিএনপিকে দায়ী করে এর প্রতিবাদে রবিবার (৩০ জুলাই) সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। অপরদিকে শনিবারের ‘অত্যাচার-নিপীড়নের’ প্রতিবাদে সোমবার (৩১ জুলাই) প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বিএনপি।
ডিএমপির নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরপরই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো তাদের কর্মসূচি স্থগিত করলেও কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্তে অটল থাকে বিএনপি। অবশ্য এর আগে শুক্রবার নয়াপল্টনের সমাবেশ থেকে দলটির ঘোষণা দিয়েছিল রাজধানীতে কর্মসূচি পালনে তারা আর পুলিশের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করবে না।
ঢাকার চারটি প্রবেশমুখে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকাল ১১টার দিকে ধোলাইখালে জড়ো হয় দলটির নেতাকর্মীরা। স্লোগান চলার একপর্যায়ে পুলিশ তাদের ধাওয়া দেয়। বিএনপির নেতাকর্মীরাও পাল্টা ধাওয়া দেয়। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ফাঁকা গুলি ও কাঁদানে গ্যাস (টিয়ারগ্যাস) ছোড়ে। সেখানে উপস্থিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দলীয় নেতাকর্মীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছিলেন। একপর্যায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ কয়েকজন আহত হন। আহত গয়েশ্বরকে পুলিশ ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে বিএনপির এই নেতাকে দুপুরের খাবার খাইয়ে নয়া পল্টনের দলীয় কার্যালয়ে ছেড়ে দেয়। এর আগে বিএনপির এই নেতাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয় পুলিশ।
এ বিষয়ে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘সংঘর্ষের সময় তার মাথা ফেটে যায়। রক্তাক্ত হয়ে পড়েন।’ পরে কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত তাকে বেধড়ক পিটিয়েছে বলে দাবি করেন। এখানে আহত অন্যরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
শনিবার সকাল ১১টায় গাবতলীর এসএ খালেক বাসস্ট্যান্ডের সামনে বিএনপির অবস্থান নেওয়ার কথা থাকলে সকালে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। এ সময় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান এবং তার সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান। তখন পুলিশ তাকে ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। বিএনপির কিছু নেতাকর্মীকেও পুলিশ আটক করে বলে অভিযোগ করা হয় দলটির নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে। সেখানে পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে দলটির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গাড়িতে করে নিয়ে যান। পুলিশ তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করে। হাসপাতালে ভর্তি আমানকে দেখতে যান প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি। প্রধানমন্ত্রী তার জন্য খাবার ও ফল পাঠান। এদিকে বিকালে আমান জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট থেকে চিকিৎসার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে যান।
এদিকে বেলা সোয়া ১টার দিকে শ্যামলী থেকে বিএনপির একটি মিছিল গাবতলীর দিকে যাওয়ার সময় শ্যামলী স্কয়ারের উল্টো দিকের সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয় বলে দাবি করে পুলিশ। এ সময় কয়েকটি বাস ও প্রাইভেটকার ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এখান থেকে কয়েকজনকে আটক করা হয়।
পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পর উত্তরায় বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিস্থলে আসেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তারা শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দফায় দফায় তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। পুলিশের ট্রাফিক উত্তরা বিভাগের পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান জানান, বিএনপি এখানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করার জন্য অনুমতি নেয়নি। মানুষের যাতে ভোগান্তি না হয় সেজন্য পুলিশ তাদের সরিয়ে দিয়েছে।
বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে মাতুয়াইল মেডিক্যাল মোড় এলাকায়। সেখানে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত সংঘর্ষ চলতে থাকে। পুলিশ-বিএনপির দফায় দফায় চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। বিএনপি কর্মীদের ইটপাটকেল নিক্ষেপের জবাবে পুলিশও পাল্টা ঢিল ও কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ে। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা। এ পর্যায়ে রণক্ষেত্রে রূপ নেয় যাত্রাবাড়ি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাতুয়াইল এলাকা। এ সময় এক কিলোমিটারের ব্যবধানে তিনটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষের কারণে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত এ মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে। ফলে ঢাকার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় দীর্ঘ দুই কিলোমিটার পথ ফাঁকা রেখে যানবাহনের সারি দাঁড়িয়ে ছিল।
বেলা আড়াইটার দিকে র্যাব, আনসার ও পুলিশের অতিরিক্ত সদস্যরা এসে বিএনপি নেতাকর্মীদের হটিয়ে দিলে মহাসড়ক ফের সচল হয়।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আজ রাজধানীতে যে অত্যাচার, নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিবাদে আমরা আগামী পরশু সোমবার (৩১ জুলাই) সারা দেশে, সব মহানগর, জেলা সদরে জনসমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করছি। আগামীকালই (রবিবার) আমরা প্রতিবাদের দিন হিসেবে পালনের কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি, আগামীকাল সরকারি দল রাজপথে কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। আমরা তাই তাদের মতো একই দিনে কর্মসূচি না দিয়ে সংকট সৃষ্টি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করবো, গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনে কোনও বাধা সৃষ্টি করা হবে না।’
আওয়ামী লীগের অবস্থান
ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশমুখ ঘুরে সকাল ১১টার পর থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। তারা নানা স্লোগান দিয়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল করে। ক্ষমতাসীন দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো রাজধানীর যাত্রাবাড়ি, দোলাইর পাড়, বাবুবাজার ব্রিজ, গাবতলী, বছিলা ব্রিজ, উত্তরা কমপ্লেক্স ও আব্দুল্লাহপুর মোড়ে দিনভর অবস্থান করে মিছিল স্লোগান দিতে থাকে। বিএনপিকে অবস্থান নিতে পুলিশ বাধা দিলেও গাবতলীতে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের অবস্থান নিতে দেখা যায়। তাদের সেখানে কয়েক দফায় মিছিলসহ মোটরসাইকেলে মহড়া দিতে দেখা গেছে। মিছিলের সময়ে তাদের হাতে লাঠিসোঁটাও দেখা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
শনিবার পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষের প্রসঙ্গ টেনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা যা আশঙ্কা করেছি, তাই সত্যি হয়েছে। অগ্নিসন্ত্রাস, তারা এটাই চেয়েছিল। আমাদের শক্ত অবস্থানের কারণে তারা গতকাল (শুক্রবার) এটা করতে পারেনি। সংঘাতের বিরুদ্ধে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা পবিত্র দায়িত্ব মনে করেছি। আমরা আগামী নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথে থাকবো।’
তিনি বলেন, ‘আমি পরিষ্কার বলতে চাই, বিএনপি অগ্নিসন্ত্রাস আবার শুরু করেছে। ঢাকা শহরে ঢুকে রাস্তা বন্ধ করে দেবে— এটা কি তার বাপ-দাদার সম্পত্তি যে যেটা ইচ্ছে সেটা করবে!’
এদিকে বিএনপির অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সারা দেশে রবিবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ঢাকার প্রতিটি থানাসহ সব মহানগর, জেলা ও উপজেলায় এই বিক্ষোভ হবে বলে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান।
ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি থেকে সংঘাতের জন্য বিএনপিকে দায়ী করেছে পুলিশ। ডিএমপি বলেছে, বেআইনি সমাবেশ থেকে বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর হাতবোমা ছুড়েছে, গাড়ি ভাঙচুর করেছে, আগুন ধরিয়েছে। জনদুর্ভোগ, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করায় ৯০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে ডিএমপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বিএনপির এই কর্মসূচি আইনগতভাবে বেআইনি দাবি করে ডিএমপির জনসংযোগ ও গণমাধ্যম বিভাগের উপকমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘অবস্থান কর্মসূচি পালনের জন্য তাদের কোনও অনুমতি দেওয়া হয়নি।’
সংঘাতের জন্য বিএনপিকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘রাস্তা থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের সরিয়ে দিতে পুলিশকে বলপ্রয়োগ এবং রাবার বুলেট ছুড়তে হয়েছে। তারা (বিএনপির নেতাকর্মীরা) ঢাকা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান করে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে, বিভিন্ন গাড়িতে আগুন দেয়, ককটেল মারে এবং পুলিশের ওপর অতর্কিতে হামলা করে, গাড়ি ভাঙচুর করে। তারা পুলিশের ৮ থেকে ১০টি গাড়ি এবং ২০টির মতো অন্যান্য গাড়ি ভাঙচুর করেছে।’
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মেহেদি হাসানসহ ২০ জনের মতো পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে তিনি জানান।
এসব ঘটনায় ৯০ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখনও গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘বিএনপি ২০১৪-১৫ সালে ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে অগ্নিসন্ত্রাস করেছিল। বিএনপি কি আবারও সেই অগ্নিসন্ত্রাসে ফিরে যাচ্ছে? রাজনৈতিক দলগুলো কর্মসূচি পালন করবে, এখানে সরকারের কোনও বাধা নেই। তবে যখন কেউ জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করবে, জানমালের ক্ষতি করবে, কাউকে মারার চেষ্টা, কিংবা হত্যা করবে অথবা গাড়ি ভাঙচুর করবে—তখন নিরাপত্তা বাহিনী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে।’