আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিলের (৩০ নভেম্বর থেকে) সময়সীমা পেছানো, মনোনয়ন ফরম জমাদানের তারিখে পরিবর্তন আসতে পারে—এমন আলোচনার মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মুক্তির বিষয়টি সামনে এসেছে। বুধবার (২২ নভেম্বর) নিম্ন আদালতে তার জামিন নামঞ্জুর হলেও উচ্চ আদালতের পর্ব রয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে অনেকটা স্পষ্ট করা হয়েছে—বিএনপি নির্বাচনে এলে তফসিল পেছাতে পারে।
বিএনপির দায়িত্বশীল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকেও তফসিল পেছানোয় অনাপত্তি থাকায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলের মুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। বিএনপির দায়িত্বশীলদের অনেকে মনে করছেন, মির্জা ফখরুল মুক্তি পেলে তফসিল সংক্রান্ত বিষয়টি আরও গুরুত্ব পাবে।
যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য এই সম্ভাবনার বিষয়টি স্বীকার করেননি।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের এসব বক্তব্য কথার কথা। এখন কার্যকর কিছু হবে না। বিএনপির নেতাদের মুক্তি দিলেও কী, তাদের তো সাজা হয়েছে। অন্তত ১৫ হাজার নেতাকর্মী এখনও কারাগারে আছে। বিএনপি যেন নির্বাচনে না আসে, সেজন্য যা যা করার সবকিছু করেছে।’
নির্বাচন বিষয়ে অধ্যাপক মজুমদারের ভাষ্য—‘‘নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, তা কথার কথা। কারণ, আমাদের অতীতে ২০১৪ সালে নির্বাচন হয়েছে একতরফা, ২০১৮ সালে হয়েছে মধ্যরাতে। এবার হচ্ছে ‘চমকের একতরফা নির্বাচন’। যেটা হচ্ছে সেটা নির্বাচনই না। নির্বাচন-নির্বাচন খেলামাত্র।’’
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘‘নির্বাচনের আইনি সংজ্ঞা হচ্ছে—অ্যাক্ট অব চুজিং। পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেওয়া। বেছে নেওয়ার জন্য বিকল্প থাকতে হবে। এই ‘বিকল্প’ হচ্ছে যথার্থ ‘বিকল্প’। ভোটারদের স্বাধীনভাবে প্রার্থী বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। দেশের রাজনীতিতে দুটি বড় প্রতীক—নৌকা ও ধানের শীষ। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেই দাঁড়াক—কিংস পার্টি, জাতীয় পার্টি ওরা কেউ যথার্থ বিকল্প না। ফলে, ফলাফল যা হবে তা পূর্বনির্ধারিত।’’
এ প্রসঙ্গে একটি দলের সাধারণ সম্পাদক নাম প্রকাশ না করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তফসিলের সময়সীমা বাড়ানোর ইঙ্গিত এসেছে সরকারি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। জাতীয় পার্টিও কিছুটা সময় চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছে। অনেককে এখনও নির্বাচনমুখী করা যাচ্ছে না—তাদের যুক্ত করা। এসব কারণে সময় লাগতে পারে বলেই ইসি ও সরকার—উভয়পক্ষ সময়সীমা পেছানোর প্রসঙ্গ তুলেছে।’
আরেকটি দলের সদস্য সচিব মনে করেন, ‘তফসিল পেছাবে। মনোনয়নপত্র জমাদান, তুলে নেওয়া, কিছু লোককে নির্বাচনে আনার বিষয়গুলো রয়ে গেছে।’
মির্জা ফখরুলের মুক্তিতে স্বাভাবিক হতে পারে দলের তৎপরতা
মির্জা ফখরুলের জামিন হলে তফসিলের বিষয়ে কোনও সমাধানের সুযোগ নেই বলে জানান নির্ভরযোগ্য একটি দলের প্রধান। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে তার সঙ্গে এই আলোচনা সরকারপক্ষের হয়েছে। এতে তিনি সায় দেননি। একইসঙ্গে সহিংসতা পরিহার ও হরতাল-অবরোধের মতো ক্ষতিকর কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য আমেরিকার তৎপরতা এখনও রয়েছে। সেই তৎপরতার মধ্য দিয়ে মির্জা ফখরুলের জামিন হলে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরতে পারে।
তফসিল পেছানোর সম্ভাবনা ও মির্জা ফখরুল প্রসঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সেটা যদি বিদেশি রাষ্ট্রগুলো মধ্যস্থতা করে, কোন প্রক্রিয়ায় হবে, নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে—এসব বিষয় সামনে এলে তফসিল পেছানোর কার্যকারিতা স্পষ্ট হবে। তবে বিদ্যমান কাঠামোতে হবে না। এই প্রশাসন থাকবে, সব ঠিক থাকবে, আর সাত দিন পেছালেই হবে না। এরকম কোনও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিএনপি বা যুগপতে যুক্ত দলগুলো যাবে না।’
নুরুল হক উল্লেখ করেন, দেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে বিদেশি বন্ধুরা রাজনৈতিক সংকটে বন্ধুর ভূমিকায় ছিল। সমঝোতার মাধ্যমে সংকট উত্তরণের পথ বের করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউসহ এমনকি সম্প্রতি ডোনাল্ড লু চিঠি দিয়েছেন সংলাপের জন্য। আমাদের ধারণা ছিল সরকার সংলাপ করবে।’
নুরুল হক নুর বলেন, ‘আমরা চাই নির্বাচনকালীন সরকার। সেটা যে নামেই হোক। সরকারকে সংলাপের সিম্পটম দেখাতে হবে। মির্জা ফখরুলসহ হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীদের মুক্তি দিলে বোঝা যাবে সরকার ইতিবাচক। না হলে যেটা (তফসিল পেছানোর আলোচনা) এখন হচ্ছে—সেটা মিডিয়ায় আনা হচ্ছে। কারণ, জাতীয় পার্টি নির্বাচনমুখী নয়। একতরফা নির্বাচনের পথে সরকার।’
২৮ অক্টোবর বিএনপি ও যুগপতে যুক্ত দলগুলোর মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ ও সরকারি নানা স্থাপনায় হামলার অভিযোগ এনে করা মামলায় গত ২৯ অক্টোবর গুলশানের বাসভবন থেকে মির্জা ফখরুলকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
৯ ঘণ্টা ডিবি অফিসে রেখে পরে মির্জা ফখরুলকে আদালতে পাঠানো হয়। ওই সময়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় বেশ কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হন। এরপর থেকে স্থায়ী কমিটির বাকি সব নেতারাই গাঢাকা দেন।
আরেকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দলের প্রভাবশালী দায়িত্বশীল উল্লেখ করেন, বিগত কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভোটাধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম, তাতে দেশে নেতৃত্ব দিয়েছেন মির্জা ফখরুল। ইতোমধ্যে তিনি গ্রেফতার হওয়ায় দলের নানা স্তরে এর প্রভাব পড়েছে। ইতোমধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি সবপক্ষের কাছে স্পষ্ট করেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, বাম-প্রগতিশীল দলগুলোও বিএনপির দাবির সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছে। সেদিক থেকে মির্জা ফখরুল মুক্তি পেলে পরিস্থিতি ইতিবাচক দিকে টার্ন নিতে পারে।
ইতোমধ্যে দলে ও দলের বাইরের নেতারাও মির্জা ফখরুলের অনুপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারছেন বলে দাবি করেন এই দায়িত্বশীল।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথমত হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বিএনপির মহাসচিবসহ দলটির স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে অন্তত ১৫ হাজার নেতাকর্মী এখন কারাগারে। যেসব অভিযোগে মির্জা ফখরুলকে কারাগারে নেওয়া হয়েছে, তা এককথায় হাস্যকর, উদ্ভট ও অবিশ্বাস্য। হয়রানির উদ্দেশ্যে আদালতকে সংগঠন হিসেবে ব্যবহার করেছে সরকার’
‘এখন তার (মির্জা ফখরুল) জামিন হলে ভালো। তিনি দলের সব কার্যক্রম শুরু করবেন। মানুষও সেটাই প্রত্যাশা করে’, বলেন সাইফুল হক।
আইনজীবীর বরাতে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, এ নিয়ে নয়বার কারাগারে গেছেন মির্জা ফখরুল। ৪৩৫ দিন কারাভোগ করে এখনও তা চলমান। ১০২টি মামলা চলছে তার বিরুদ্ধে।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য বছরের পর বছর ধরে রাজপথে লড়াই করছে। শত শত তরুণ আত্মাহুতি দিয়েছে। প্রায় ১৫ হাজার নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছে। লাখ লাখ নেতাকর্মী প্রতিদিন রাজপথে সংগ্রাম করছে শেখ হাসিনাকে রেখে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য?’
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে বিএনপি কোনও নির্বাচনে যাবে না’ উল্লেখ করে ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, ‘কেবল মির্জা ফখরুল কেন, ১৫ হাজার নেতাকর্মীকে মুক্তি দিলেও না। ভেরি লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার।’ তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘আমরা কি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করতে আন্দোলন করছি?’
দলের স্থায়ী কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলমান থাকায় বিএনপির পক্ষ থেকে আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দেওয়া হবে।’
আরও পড়ুন:
প্রধান বিচারপতির বাসায় ভাঙচুর মামলায় মির্জা ফখরুল গ্রেফতার