চলতি মাসেই বাংলাদেশ থেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দূর হয়ে যাবে বলে গত ২৭ এপ্রিল একটি গবেষণায় দেখিয়েছে সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন (এসইউটিডি) এর ডাটা ড্রিভেন ইনোভেশন ল্যাব। বিশ্বব্যাপী ভয়াল থাবা বিস্তারকারী এই ভাইরাস নিয়ে এ গবেষণাটি কতটা কার্যকরী হতে পারে তা বিশ্লেষণ করেছেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ও এমআইটিতে অধ্যয়নরত চার বাংলাদেশি গবেষক। পড়ুন তার বিস্তারিত:
১. সিঙ্গাপুর যে মডেলটি ব্যবহার করেছে তা একটি টয় মডেল: আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি কোনোভাবে এ থেকে ধারণা নেন, তাহলে তার ফলাফল বিপর্যয়কর হতে পারে।
২. এই মহামারির সময়ে প্রত্যেকেই আগ্রহ নিয়ে একটি ভালো খবরের অপেক্ষায় আছে। সে কারণে এই ধরনের ভালো খবর ভাইরাল হয়ে যাবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবে যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তাহলো এই ধরনের প্রাথমিক পর্যায়ের (প্রি-পাবলিকেশন), পর্যালোচনাবিহীন, গবেষণার ফল প্রকাশ করার নৈতিকতা কতটুকু।
৩. বাংলাদেশে লকডাউনের কারণে কোভিড-১৯ বিস্তারের হার কমেছে, কিন্তু এটা নির্মূল থেকে এখনও আমাদের অবস্থান অনেক দূরে।
এই ধরনের মডেল কেন কেবল টয় মডেল?
মানুষের পারস্পারিক মিথষ্ক্রিয়া কোভিড-১৯ বিস্তারের মূল চালিকাশক্তি। ফলে প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত আমরা দুটি পর্যায় দেখতে পেরেছি। এক. লকডাউনের আগে: সবাই যখন উন্মুক্তভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে তখন ভাইরাসটি আশঙ্কাজনক হারে বিস্তার লাভ করেছে। দুই. লকডাউনের মধ্যে: মানুষ যখন খুব বেশি ঘুরে বেড়ায়নি তখন ভাইরাসটির বিস্তারের হার কমেছে।
সিঙ্গাপুরের মডেলটিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এখানে এসব পরিবর্তন ও পার্থক্যকে বিবেচনায় নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। কারণ, এই পদ্ধতিতে মহামারির উভয় পর্যায়ের ক্ষেত্রেই একই মডেল ফিট করা হয়। যেহেতু উভয় পর্যায়কে এক সমীকরণে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই ভাইরাসটির বিস্তার কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখানো হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবতা হলো আমরা কেবলই প্রথম পর্যায় থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করেছি। এখন যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে আমরা যদি দেশের সবকিছু খুলে দেই তাহলে আমরা পূর্ববর্তী পর্যায়ে ফিরে যাবো। আর এই মডেল এই বিষয়টি বিবেচনায় নেয় না।
পৃথকভাবে, দীর্ঘ মেয়াদে কোনও দেশের কোভিড-১৯ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাওয়ার একমাত্র রাস্তা হলো দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করা। এটি দুই ভাবে অর্জন করা যায়। যখন বেশিরভাগ মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে যায় (যেমন চিকেন পক্স), কিংবা সবাইকে টিকা দেওয়া হয় (যেমন পোলিও) । মূল উদ্বেগ হলো আমরা যদি খুব শিগগিরই লকডাউন প্রত্যাহার করে নেই তাহলে দ্বিতীয় ধাপে বিপর্যয়কর সংক্রমণ হতে পারে।
এই ধরনের গবেষণা কি অনৈতিক?
সিঙ্গাপুরের গবেষণাটি প্রকাশকারী ওয়েবসাইটটিতে (https://ddi.sutd.edu.sg/when-will-covid-19-end) পরিষ্কারভাবে বলে উল্লেখ করা আছে যে এই মডেলটি কেবলমাত্র শিক্ষা ও গবেষণার উদ্দেশে তৈরি এবং এটি প্রতিটি দেশের পরিস্থিতি নির্ভুলভাবে আগাম অনুমান করতে সফল নয়। তারা পাঠকদের এই গবেষণার ফলাফল বিচার করে দেখতে বলেছে এবং সতর্কতার সঙ্গে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তারা আরও উল্লেখ করেছে এসব ফলাফলের ভিত্তিতে অতি-আশাবাদী হওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক।
এছাড়া আরেকটু গভীরে খতিয়ে দেখা যাক। এটা পরিষ্কার যে এই গবেষণায় এসআইআর মডেল ব্যবহার করা হয়েছে। এই মডেলটি মহামারি অনুমানের ক্ষেত্রে খুবই প্রাথমিক একটি মডেল যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৭ সালে । এই মডেলটি বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যার পার্থক্য এবং তাদের আচরণগত পার্থক্য বিবেচনায় নেয় না। কেবল তাই নয়- তাদের প্রকাশ করা গ্রাফগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে ফলাফলে পৌঁছাতে তারা কেবল একটি গতিপথকেই বিবেচনায় নিয়েছে। ইতিপূর্বে উল্লেখিত জনতাত্ত্বিক বিষয়গুলোর কোনও কিছুই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এই মুহূর্তে এই ধরণের গবেষণা কেবল বিপদজনক নয় বরং তা অনৈতিকও।
প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে টেস্ট করার হার বাংলাদেশে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম। এখন পর্যন্ত আমরা প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ৩৮.৪ জনের পরীক্ষা করতে পেরেছি। উন্নত দেশগুলোতে এই সংখ্যা দুই থেকে তিন হাজার। উন্নত দেশগুলোর কথা বাদ দিলেও আমাদের পরীক্ষার হার ভারত (প্রতি লাখে ৬১) এবং পাকিস্তানের (প্রতি লাখে ৭৯.৫) চেয়েও কম।
সবশেষে বলা যায়, আমরা যদি দক্ষিণ কোরিয়া বা ভিয়েতনামের পথ অনুসরণ না করি, আর প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের টেস্ট করাতে না পারি, তাহলে দেশে যে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে না তা আমরা প্রমাণ করতে পারবো না। এসব পদক্ষেপ নিতে যদি আমরা ব্যর্থ হই তাহলে আমরা হয়তো মে মাসের পর আরও বিপর্যয়কর দ্বিতীয় ধাপের সংক্রমণ দেখতে পাবো।
গবেষকদল: তারিক আদনান মুন (হার্ভার্ড ’১৫), নুর মোহাম্মদ শফিউল্লাহ (এমআইটি ’১৯), আদিব হাসান (এমআইটি ’২১), সানজিদ আনোয়ার (এমআইটি ’২০)।