‘করোনায় কর্মসংস্থান হারালেও ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব’

1করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশে ৬০ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থান হারালেও এক বছরের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। সম্প্রতি সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ‘বাংলাদেশ অ্যাট ওয়ার্ক: জব ক্রিয়েশন অ্যান্ড ইনক্লুসিভ গ্রোথ ইন দ্য এরা অফ কোভিড-১৯’ শিরোনামের গবেষণা প্রবন্ধে এমন সম্ভাবনার কথাই উঠে এসেছে। সিআরআই-এর হয়ে যৌথভাবে গবেষণাটি করেছেন ইমরান আহমেদ ও সৈয়দ মফিজ কামাল।
গবেষণায় কর্মসংস্থান রক্ষায় এক বছরের জন্য পাঁচটি পরামর্শ উঠে এসেছে। এই প্রসঙ্গে ইমরান আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের প্রবন্ধের মূল জায়গাটা হলো নীতি-নির্ধারকরা যেন কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করেই ইকোনমিক রিকভারি নিয়ে ভাবেন। মাত্র এক বছরের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিলেই কর্মসংস্থানের সংকট থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।  

গবেষক সৈয়দ মফিজ কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দেখেছি করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশে সর্বোচ্চ তিন কোটি ৮০ লাখ নতুন দরিদ্র তৈরি হবে। গ্রামাঞ্চলে এই নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হবে দুই কোটি ৭০ লাখ এবং শহরাঞ্চলে এক কোটি ১০ লাখ। বর্তমান দরিদ্রের হারের সঙ্গে এই বিপুল নতুন দরিদ্র মিলে বাংলাদেশে দারিদ্রের হারকে ৩৩.২-৪১.৫ শতাংশে নিয়ে যেতে পারে।

তবে এসব সংকট থেকে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব বলেও মনে করেন সৈয়দ মফিজ কামাল। তিনি বলেন, সরকারের প্রণোদনা ও বাজেটের মাধ্যমে কিভাবে কর্মসংস্থানকে ফিরিয়ে আনা যায় সে বিষয়টিকে সামনে আনার জন্যই আমরা গবেষণাটি করেছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্যই হলো, সংকট থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। আর এজন্যই গবেষণার ভিত্তিতে পাঁচটি পরামর্শ তুলে ধরা হয়েছে।

প্রথমত, যেসব খাতে প্রচুর লেবার রয়েছে সেগুলোতে প্রণোদনা বাড়ানো যেতে পারে। এই খাতের মধ্যে আছে কৃষি, তৈরি পোশাক, চিকিৎসা-সামগ্রী উৎপাদন, খাবার প্রসেসিং, যানবাহন, নির্মাণ, খুচরা ব্যবসা, স্বাস্থ্য ও ফার্মাসিউটিক্যালস।

এর কারণ হিসেবে ইমরান আহমেদ বলেন, এসব খাতে প্রচুর পরিমাণে কর্মক্ষম মানুষের প্রয়োজন হয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশে যেহেতু কর্মক্ষম প্রচুর তরুণ রয়েছে তাই তাদের এসব খাতে কাজে লাগানো যেতে পারে।

গার্মেন্টখাতে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটলেও গবেষকরা মনে করেন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী তৈরির বিষয়ে কাজ করলে এই খাতটিও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। যেহেতু মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই’র চাহিদা দেশ ও বিদেশে রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত শুরু করার বিষয়েও গবেষণায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যেসব উন্নয়ন প্রকল্প শ্রমিক নির্ভর বেশি সেসব প্রকল্পকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়। একইসঙ্গে ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ প্রকল্পকে এর যুক্ত করে গ্রামাঞ্চলে প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব।

তৃতীয়ত, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে অর্থের জোগান সহজ করার বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে গবেষণায়। এইসব অতিক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাগুলোতে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রণোদনা দেওয়া হলেও এর বাইরে এনজিও’র সহযোগিতায় ঋণের অর্থ সহজে ও দ্রুততম সময়ে পাওয়ার ব্যবস্থা করলে অর্থনীতির চাকা দ্রুত ঘুরতে শুরু করবে বলেও গবেষকরা মনে করেন।

চতুর্থত, স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ও ফিরে আসা প্রবাসীদের দক্ষতা উন্নয়নে মনোনিবেশ করার বিষয়েও গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গবেষকদের মতে, সাধারণত সরকার যেসব কারিগরি বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে আসছে তার বাইরেও এখন স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া দেওয়া জরুরি। কারণ দেশ ও বিদেশে এখন প্রয়োজন হবে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী। এজন্য গবেষণায় বলা হয়, যেসব প্রবাসী কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন তাদের স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিলে নতুন কর্মসংস্থান সুযোগ তৈরি হবে।

পঞ্চম ও সর্বশেষ স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক গতি আনতে ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ প্রকল্পকে ফাস্ট ট্র্যাকে নেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে গবেষণায়। বলা হয়েছে, শহরমুখী না হয়ে যদি গ্রামে সকল সুযোগ-সুবিধা ও ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া যায় তাহলে গ্রামের মানুষ গ্রামে থেকেই ব্যবসায় করতে পারবে। সরকার এই বিষয়ক যে উদ্যোগ আছে সেটাকে আরও বিস্তৃত ও দ্রুত করা গেলে স্থানীয় উন্নয়ন সম্ভব।

এছাড়াও চীন থেকে অনেক উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান সরে যাচ্ছে। ভিয়েতনামের মতো দেশেও এখানে সুযোগ নিচ্ছে, আর তাই বিদেশি বিনিয়োগের এই সুযোগ বাংলাদেশও নিতে পারে বলে গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে।

‘বাংলাদেশ অ্যাট ওয়ার্ক: জব ক্রিয়েশন অ্যান্ড ইনক্লুসিভ গ্রোথ ইন দ্য এরা অফ কোভিড-১৯’ গবেষণার দুই গবেষক ইমরান আহমেদ ও সৈয়দ মফিক কামাল আশা প্রকাশ করে বলেন, এক বছরের মধ্যে এই সব পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়ন করা যায় তবে খুব দ্রুত মানুষ তাদের কাজে ফিরে যেতে পারবে এবং অর্থনৈতিক চাকাও দ্রুত গতিতে সচল হবে।

উল্লেখ্য, গবেষণায় বলা হয়, হারিয়ে যাওয়া কর্মসংস্থানের একটা বড় অংশ সব কিছু স্বাভাবিক হলে দ্রুতই ফিরে আসবে। যেমন, কৃষির কর্মহীন মানুষরা আবার কৃষির সিজন আসলে কর্মব্যস্ত হয়ে পড়বেন, মানুষের চলাচল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ ফিরে পাবেন রিকশা ও সিএনজি চালকসহ পরিবহন খাতের শ্রমিকরা। তবে ৬০ লাখ চাকরি দীর্ঘ মেয়াদের জন্য হারিয়ে যাবে। যা দেশের মোট লেবার ফোর্সের ১০ শতাংশ। অর্থাৎ করোনার প্রভাবে মোট লেবার ফোর্সের ১০ শতাংশ দীর্ঘ মেয়াদে আয়ের উৎস হারাবেন।