নীতি-নির্ধারকদের গভীরভাবে চিন্তা করার সময় হয়েছে

গাজী আশরাফ হোসেন লিপু

স্থান-কাল ভেদে যে কোনও ব্যাটসম্যান যদি কয়েকটি ইনিংসে রান করতে না পারে তবে সচরাচর তার নিজের অগাধ আস্থায় ফাটল ধরে। তখন নিজের সামর্থ্যের ওপর নিজের বিশ্বাসটুকু জলীয় বাষ্পের মতো স্থানচ্যুত হয়ে অগোচরে উড়ে চলে যায়; সমষ্টিগতভাবে যখন তা ব্যাটিং বিভাগের সঙ্গে হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানদের সহজে করা ৪টি শতরান বা লিটন দাসের প্রথম ইনিংসের সাহসী ব্যাটিংও তাদের শেষ টেস্ট ইনিংসে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের অনুপ্রাণিত করতে পারেনি। যার মধ্য দিয়ে দলগত বা এককভাবে শেষ ইনিংসটিতে তাদের ক্রিকেটীয় সামর্থ্যটুকু মেলে ধরা যায়। দক্ষিণ আফ্রিকাতে সফলতার আকাশ প্রায়ই টেস্ট সিরিজে মেঘে ঢাকা থাকবে অনুমান অনেকেই করেছে কিন্তু তার মাঝে মিষ্টি রোদের দর্শণ পাব না তার সঙ্গে হিসাবটা বড় বেশি গড়মিল হয়ে গেলো।

প্রায় সকল ক্রিকেট অনুরাগীদের প্রতিক্রিয়া থেকে ধরেই নিচ্ছি মুশফিকের পিচ পর্যবেক্ষণ ভুল ছিল। সে কারণেই দুই টেস্টেই তার সিদ্ধান্তটা সকলে সঠিক মনে করেননি। এটাও বলতেই হয় আমরা সুযোগের সদ্ব্যবহার শতভাগ করিনি। পিচের আচরণগত পরিবর্তন প্রথম টেস্টে কিছুটা লক্ষণীয় ছিল যা স্পিন বোলার কেশব মহারাজকে সাহায্য করেছে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা দলে তিনি ছিলেন একমাত্র স্পিনার। কাজেই উভয় প্রান্ত থেকে সেই সুবিধা দক্ষিণ আফ্রিকা নিতেও পারেনি। কারণ প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংস আমাদের ৩৩ ওভারেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ব্লুমফন্টেইনে দ্বিতীয় টেস্টের পিচের আচরণে প্রথম ও তৃতীয় দিন পর্যন্ত আমি উল্লেখযোগ্য বোলিং সহায়ক কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি।

উভয় টেস্টেই খেলা শুরুর পর বাংলাদেশকে খেলার ১০ ঘণ্টার মাঝে পিচে ব্যাট করতে আসতে হয়েছে। তারা তাদের নিজের খেলাটা মোটেই সঠিকভাবে খেলতে পারেননি বলেই এই বিপর্যয় এবং বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতা ঠেকানোর মানসিক শক্তি, পিচে আত্মবিশ্বাসী উপস্থিতি, ব্যাটিংয়ের গুণগত আত্মরক্ষার কৌশল বা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শট খেলার বা বল ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে বড় বেশি অনুজ্জ্বল ছিল আমাদের ব্যাটসম্যানরা। এখানে আগে বা পরে ব্যাট করাটা মূল ব্যবধান ছিল বলে কখনই মনে হয়নি।

চকচকে বলটা যদি আমাদের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান সামাল দিতে পারতো তবে ৩০ ওভার থেকে ক্রমাগত রিভার্স সুইংয়ের ডেলিভারিগুলিও মোকাবেলাটা সহজ হতো এবং এই কাজটি করতে পারলে লিটন দাসের মতো অনেকেই একাধিক আত্মবিশ্বাসী ইনিংস খেলতে পারতেন সহজেই। লক্ষ্য করে দেখবেন আমাদের প্রথম ৭ ব্যাটসম্যান উভয় ইনিংসে সামনের দিকে পরিপূর্ণ শটস খেলে আউট হয়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল সাব্বির রহমানের প্রথম ইনিংসের আউট। কেন অধিকাংশ খেলোয়াড় উইকেটের পেছনে বা বোল্ড হলেন? শন পোলক প্রথম দিনেই বলেছিলেন মাঝ পিচে যথেষ্ট ঘাস আছে এবং সেই আলোকে পিচের উপরের অংশে সবুজ ঘাসের পরিমাণ যথেষ্ট কম। অর্থাৎ শর্ট পিচ বল যে মূল অস্ত্র হবে তা ছিল অনুমেয়। এক বিশ্লেষণে দেখলাম এক সফল বোলার ৫০ ভাগেরও বেশি শর্ট পিচ বল করেছেন এবং বাকি ৫০ভাগ ছিল ভালো লেন্থ ও ফুল লেন্থের বল। বিশেষ করে ফেলুকায়োর কথা উল্লেখ করা যায়। গতি ও কার্যকর বাউন্সার দিয়ে ব্যাটসম্যানদের মনে যে সংশয় তৈরি করেছিলেন তার ফায়দা হিসাবে উপরের লেন্থে বল করে অধিকতর সফলভাবে উইকেট তুলে নিয়েছেন।

শর্টপিচ বল ছেড়ে দিয়ে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় নেই। ইমরুল, লিটন ও মুমিনুল কাউন্টার অ্যাটাক করেছিলেন। কিন্তু দিন শেষে বোলারই সফল হয়েছেন। মুমিনুল ও মুশফিকের হেলমেটে বল লাগার ব্যাপারটি বলে দেয় বাউন্সার ছাড়ার কৌশলের চর্চা বলের প্রতি চোখ রেখে করতে হবে।

ম্যাচ শেষে শন পোলকের কথাটি সবচেয়ে বেশি সঠিক মনে হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা সফর ঘিরে আমাদের প্রস্তুতি ভালো হয়নি। এই প্রস্তুতি অনেকদিন আগে থেকেই নেওয়া উচিত ছিল। তা কোচিং স্টাফরা হয়তো করেনি বা একজন খেলোয়াড় তার চ্যালেঞ্জ কী তা যথার্থভাবে অনুমান করে এককভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেননি।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে স্পিন সহায়ক পিচে আমরা খেলেছি তা দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে প্রস্তুতির আলোকে কোন কাজেই আসেনি। ক্রিকেটের পরিপূর্ণ অবকাঠামো গড়ার জন্য আমাদের যে আরও অনেক কিছু করতে হবে তা বোর্ড কর্মকর্তাদের উপলব্ধিতে আসলে খুশী হব।

পিচ তৈরির কৌশল, অতিরিক্ত সুবিধা নেওয়ার কৌশল বা যে খেলোয়াড়টির ব্যাটিংয়ের ধারা টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে যায় না তাকে টেস্ট ক্রিকেটার বানিয়ে যে ক্ষণস্থায়ী সফলতার দর্শনে কোচ বিশ্বাসী এটি দীর্ঘমেয়াদের জন্য আমাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। সঠিক ভিতবিহীন কৃত্রিম কোনও কিছু সাময়িক সুবাস ছড়ালেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

একদিনের ক্রিকেট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য কোচ হাথুরুসিংহেকে নিয়োজিত করে টেস্ট ম্যাটের জন্য ভিন্ন কাউকে দায়িত্ব দিয়ে তার ‍সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে নীতি নির্ধারকদের গভীরভাবে চিন্তা করার সময় হয়েছে। কারণ তিনি যেহেতু বিশ্বকাপ ও সীমিত ওভারের ক্রিকেট নিয়েই বেশি কেন্দ্রীভূত চিন্তা করছেন তখন টেস্টের দেখভালের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে স্বার্থজনিত সংঘাতের (conflict of interest) বিষয়টি বড় চোখে পড়ে যায়।

বোর্ডের এক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জেনেছি মুশফিক টস জিতে একক সিদ্ধান্তে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেখানে হেড কোচের অবস্থান ছিল ব্যাটিং! এই অবস্থায় মুশফিকের ব্যাটিংয়ের ওপর আস্থাটা কমই মনে হচ্ছে। আবার গণমাধ্যমে মুশফিক যখন বলেন তিনি ফিল্ডিং কোথায় করবেন, তাকে টিম ম্যানেজমেন্টের নির্দেশও পালন করতে হয়। তখন বুঝাই যায় এক প্রকার ত্রিমুখী চাপের মুখে রয়েছে মুশফিক। এই অবস্থায় নির্ভার থেকেই মুশফিককে নিজের দায়িত্ব পালন করাটা যুক্তিসংগত।

এছাড়া যে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ৫০ টেস্ট খেলে ফেলেছেন, যার ৩ হাজারের বেশি রান। তিনি ভালো মন্দ পরখ করে পিচটাকে ও খেলাটাকে আমাদের চেয়ে বেশি বুঝেন না তা আমি বিশ্বাস করি না। তাদের কৌশলের সঙ্গে ক্রিকেট অনুরাগীদের মতের অমিল থাকতেই পারে। তবে তাদের মেধার ওপরেই আমাদের আস্থা রাখত হবে।

তবে এমন কঠিন সিরিজের আগে টিম ম্যানেমজমেন্টকে কঠিন হোমওয়ার্ক করেই আসতে হবে। তার খেলোয়াড়দের প্রস্তুত করার দিকে আরও আন্তরিক হতে হবে। যাতে এমন বিব্রতকর ফলাফলের জন্য আমাদের ভবিষ্যতে আক্ষেপ করতে না হয়!