বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে এসে আর্চারির সোনার মেয়ে

ইতি খাতুন।দারিদ্রের কষাঘাতে তাদের জীবন তখন জর্জরিত। তিন কন্যার জনক এমদাদ আলী হোটেলে কাজ করে সংসারের ঘানি টানছেন। কী মনে করে হঠাৎ তার মেজো মেয়ে ইতি খাতুনের বিয়ে ঠিক করলেন। ইতির বয়স কতো হবে তখন, এই ১৩ বছরের মতো! জানতেন বাল্যবিবাহ। তবু দারিদ্রের হাত থেকে বাঁচতেই মেয়েকে অন্যের ঘরে পাঠা্নোর ব্যবস্থা করলেন।

সেই সময়ে ইতি সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে মাঠে-ময়দান দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। স্কুলেও নিয়মিত। ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া মেয়েটি কিনা হঠাৎই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে! এমন খবর শুনে ইতির তো মাথায় হাত।

যতই দিন গড়াচ্ছিল, ইতি স্বপ্ন দেখছিলেন হোটেলে কাজ করা বাবার সংসারের হাল ধরবেন একসময়। যেন সংসারে সবার মুখে ফোটে হাসি। কিন্তু বিয়ের পিঁড়িতে বসলে তো স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে! ওই সময়ই আবার চুয়াডাঙায় আর্চারির প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্প চলছিল। সেখানে ইতি বাছাইয়ে টিকেও গেলেন। ঢাকায় যাওয়ার হাতছানি তার সামনে।

২০১৬ সালের শেষের দিকে ঢাকায় এসে আর্চারিতে ক্যারিয়ার গড়বেন, নাকি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসবেন-কিশোরী ইতি পড়ে গেলেন দোটানায়। তবে দ্রুতই দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে পারলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ে নয়, আর্চারিই হবে ধ্যানজ্ঞান। যে কথা সেই কাজ। বিষয়টি জানানো হলো স্থানীয় কোচ সোহেল আকরামকে। বিয়ের আয়োজন প্রায় সারা। আগেরদিন কোচসহ অন্যরা ইতির বাবাকে বোঝাতে গিয়ে বেশ বেগ পেয়েছেন। সংসারের খরচও তারা মেটাবেন, এমন প্রতিশ্রুতি পর্য়ন্ত তাদের দিতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাল্যবিবাহ রোধ করা হলো। পরিবারের সবাইকে বুঝিয়ে বিয়ের আগের রাতেই ঢাকার বাসে চাপেন ইতি।

ওটাই ইতির ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। তিন বছরের মাথায় ইতির ছোট্ট ক্যারিয়ার স্বার্থক। নেপালে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে তিনটি সোনা জিতে পুরো সবাইকে দিলেন চমকে। রিকার্ভ একক, মিশ্র ও দলীয় ইভেন্টে তার এই সাফল্যে গর্বিত পুরো দেশ । চারদিক থেকে প্রশংসা পাচ্ছেন। সংবর্ধনাও কম পাননি। এখন পর্যন্ত ১১ লাখ টাকা পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়া চুয়াডাঙা জেলা প্রশাসন থেকে শহরে তিন কাঠা জমি পেয়েছেন পুরস্কার হিসেবে। দু’একদিনের মধ্যেই তা নিবন্ধন করবেন। ইচ্ছে আছে সেখানে বাড়ি করবেন।

যে বাবার চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে বিয়ে ঠেকিয়ে আর্চারি খেলা শিখেছেন, সেই আর্চারি তাকে দু’হাত ভরে দিচ্ছে। নিজ শহরে শুধু বাড়িই করবেন না, ছোটবেলার চাওয়াটাও পূরণ করতে চান।

বাবাকে আর অন্যের হোটেলে কাজ করতে দেবেন না। অদূর-ভবিষ্যতে নিজেই দেবেন হোটেল। সেই হোটেল চালাবেন তার বাবা।

ইতিই বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘বাবাকে একটি হোটেল করে দেবো। যেন নিজেই তা দেখাশোনা করতে পারেন। তাকে আর অন্যের হোটেলে কাজ করতে দিতে চাই না। আমি ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতাম পরিবারের হাল ধরবো। এখন কিছুটা হলেও তা করতে পেরে ভালো লাগছে।’

নবম শ্রেণির ছাত্রী ইতি এখন পরিবারের নয়নমণি। চারদিকে তার প্রশংসা। বাবা-মাসহ পরিবারের সবাই তার আলোকিত পারফরম্যান্সে খুশি। ইতিই বললেন, ‘বাবা এখন আমাকে অনেক ভালোবাসে। ছোটবলোয় বিয়ে না দিয়ে ভালোই করেছেন, এটা  উপলব্ধি করতে পেরেছেন।’

চুয়াডাঙার মুসলিমপাড়ার মেয়েটি ছিল বেশ ডানপিটে। আশ-পাশের অনেকেই তাকে বাঁকা চোখে দেখতেন। একজন মেয়ে হিসেবে খেলাধুলা করবে, এটা অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। এজন্য অনেক কটু কথাও শুনতে হয়েছে। তাই বলে মেয়েটি হতোদ্যম হয়নি। ছোটবেলা থেকেই দুর্দমনীয় সাহস তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।  তাই  এখন প্রতিবেশীসহ আত্মীয়-স্বজন সবারই তাকে নিয়ে অনেক গর্ব। সেই মেয়েটিই আজকের চ্যাম্পিয়ন আর্চার ইতি খাতুন!

আর্চারিতে এখানেই থেমে থাকতে চান না ইতি। অলিম্পিক পর্যন্ত তার চোখ্, ‘মানুষ তার স্বপ্নের চেয়ে বড়। আমিও স্বপ্ন দেখি একদিন অলিম্পিকে খেলতে পারবো। দেশবাসীর মুখে আবারও হাসি ফোটাতে পারবো। চেষ্টা করলে মানুষ কী-না পারে।’

চুয়াডাঙা থেকে ঢাকায় এসে তিন বছরের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে তিনটি সোনার পদক জয়। এমন চমকের রাস্তাটা অলিম্পিক পর্য়ন্ত লম্বা তো হতেই পারে।