৭ বছর আগে ইডেন গার্ডেন্সে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের একটি ম্যাচে পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের সেই ম্যাচ শুরুর আগে প্রত্যাশা ছিল এপার বাংলার মানুষের শতভাগ সমর্থন পাবে টাইগাররা। কিন্তু ম্যাচের দিন দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। সে দিন ইডেনের গ্যালারি থেকে পাকিস্তানের পক্ষেই বেশি গর্জন উঠেছে। তবে এবার দুই দলের পারফরম্যান্সেই ভাটা থাকায় মাঠে যথেষ্ট দর্শক সমাগম নিয়েও সংশয় আছে। এমনিতেই বাংলাদেশের হতশ্রী পারফরম্যান্সের কারণে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচ দেখেই অনেকে দেশে ফিরে গেছেন। অনেকের কাছে পাকিস্তান ম্যাচের টিকিট থাকলেও তারা মাঠে যাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সব মিলিয়ে তাই ইডেনে বাংলাদেশ দল নিশ্চিতভাবেই খুব বেশি সমর্থন পাচ্ছে না।
ভিসা জটিলতার কারণে আগ্রহ থাকলেও অনেক বাংলাদেশি খেলা দেখতে ভারতে আসতে পারেনি। তবুও গত কয়েকদিনে কলকাতার মারকুইজ স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিটের মতো জায়গায় ঘুরে মনে হবে, এ যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। সাকিব আল হাসানদের খেলা দেখতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি কলকাতায় আছেন। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে দলের বাজে পারফরম্যান্সে অনেকে রাগে ক্ষোভে কলকাতা ত্যাগ করলেও একটি অংশ দলের পাশে থাকতে কলকাতায় থেকে গেছেন। তারা মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে দলকে অনুপ্রেরণা দিতে মাঠে থাকবেন।
ক্রিকেটের নন্দনকাননে বাংলাদেশের ম্যাচ, স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের পক্ষে স্লোগান ওঠার কথা। কিন্তু অতীত ইতিহাস বলে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে বাংলাদেশের দর্শকরা কোণঠাসা হয়েই থেকেছে কলকাতায়। তার ওপর স্বদেশি দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় সাকিব-মুশফিকদের সমর্থন পাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবেই পাক-ভারত সম্পর্ক বৈরিতায় ভরা। কিন্তু কলকাতা নিউ মার্কেটের আশপাশের এলাকায় প্রচুর মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। এই কারণেই ভারতে পাকিস্তান ক্রিকেটের ভক্ত একেবারে কম নয়। অনেক আটকে পড়া মানুষ বেশ পাল্টে পাকিস্তানি থেকে ভারতীয় বনে গেছেন। তেরঙ্গা পতাকা তলে আশ্রয় নিলেও হৃদয়ে এখনও পাকিস্তানের চাঁদ-তারা ধারণ করেন। তা বেশ বোঝা গেলো সোমবার ইডেনে গিয়ে। এদিন দুপুরে অনুশীলন করেছে পাকিস্তান। কলকাতার মানুষের পাকিস্তানের প্রতি আলাদা ভালোবাসা রয়েছে, এ দিনের একটি চিত্র দেখলেই বোঝা যায়। অনুশীলনের ফাঁকে গ্যালারির এক প্রান্ত থেকে ‘বাবর, বাবর’ চিৎকার। এই জোরালো অভ্যর্থনা বোধ হয় আন্দাজ করতে পারেননি পাকিস্তান কাপ্তান। ইডেনের মূল গেটে ঢোকার পরেই কিছুক্ষণের জন্য থামলেন। কাঁধে সবুজ ব্যাগ। স্থানীয় ম্যানেজারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঢুকলেন ড্রেসিংরুমে। বাবরকে ঘিরে এই উন্মাদনা দেখে অনেকেই খানিকটা অবাক হতে পারেন।
বাবরও নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে ভক্তদের ভালোবাসার জবাব দিলেন গ্যালারির সামনে গিয়ে। হাত মেলালেন, সেলফির আবদার রাখলেন, দিলেন অটোগ্রাফও। বোঝাই যাচ্ছে বাংলাদেশকে লড়তে হবে গ্যালারিতে থাকা পাকিস্তানি সমর্থকদের সঙ্গেও। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচেও ভারতীয়দের কাছ থেকে সমর্থন পায়নি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশকে কেন সাপোর্ট করছে না ভারতীয়রা? পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ কেন করাচি রূপ নেয়। এসব নিয়ে ভারতীয় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেলো পারফরম্যান্স ভালো না হওয়ার কারণেই তারা বাংলাদেশকে সাপোর্ট করছে না। এছাড়া ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে প্রচুর ট্রল হয়। এই কারণে প্রতিপক্ষ যেই হোক না কেন, ভারতীয়রা বাংলাদেশের বিপক্ষে যাচ্ছে। অন্যদিকে পাকিস্তানকে সাপোর্ট করার মূল কারণ পাকিস্তানপ্রীতি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলেও ভারতীয় অনেকের মননে-মগজে পাকিস্তান। এই কারণে সুযোগ পাওয়া মাত্রই তারা পাকিস্তানিদের পক্ষে চলে যায়। স্বাভাবিকভাবেই শুধু কলকাতায় নয়, ভারতের কোনও ভেন্যুতেই ভারতীয়রা বাংলাদেশকে সাপোর্ট করছে না।
এই তো গেলো ভারতীয় সমর্থকদের কথা। বাংলাদেশি সমর্থকরাও এই মুহুর্তে নিজ দেশকে সাপোর্ট করছে না। মির্জা গালিব স্ট্রিটে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তাদের সবার কাছেই বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচের টিকিট ছিল। সেই টিকিট তারা কম মূল্যে বিক্রয় করে দিয়েছেন। তারা মাঠে না গিয়ে কলকাতার আশপাশে ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন ফাহিম আবেদিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কষ্ট করে দলকে সমর্থন দিয়ে মাঠে গলা ফাটাই। কিন্তু বাংলাদেশ যেমন পারফরম্যান্স করছে তাতে ম্যাচ দেখার আগ্রহ পাচ্ছি না। আমরা যেহেতু ১ তারিখ দেশে ফিরবো, সে কারণে কালকে মাঠে গিয়ে সময় নষ্ট করবো না। একটু ঘোরাফেরার পাশাপাশি কিছু শপিং করবো।’
ফাহিম আবেদিনের মতো এমন শখানেক মানুষ কলকাতায় আছেন। যারা সাকিবদের খেলা দেখে চরম বিরক্ত। অনেকে তো ক্রিকেটারদের তীব্র সমালোচনাও করলেন। সাকিবসহ বর্তমান ক্রিকেটারদের বাদ দিয়ে নতুনদের নিয়ে পরিকল্পনার কথা জানালেন আশফাক নামের এক চাকরিজীবি। তিনি পাকিস্তান ম্যাচে মাঠে যাবেন দলকে সমর্থন জানাতে। তার দাবি, ‘বোর্ডসহ পুরো দলকেই নতুন করে সাজাতে হবে। নয়তো অদূর ভবিষ্যতে ফুটবলের মতো ক্রিকেটও হারিয়ে যাবে।’
চন্দন দত্ত নামের ভারতীয় এক টেক্সিচালক, দাদার বাড়ি পাবনায়। টেক্সিতে চড়তেই তার প্রশ্ন আপনাদের দল এগুলো কী খেলছে দাদা? নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তিনি মাঠে না থাকলেও ম্যাচটির খবর নিয়েছেন। এমন শোচনীয় হারের পর ভারতীয় নাগরিক হয়েও বাংলাদেশের জন্য মন কাঁদছে তার।
তারপরও কিছু ভক্ত আছেন যারা মাঠে থাকবেন, দেশের জন্য গলা ফাটাবেন। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে আগের ম্যাচেও মাঠে বসেই দলকে প্রেরণা যোগানোর চেষ্টা করেন। যদিও দলের হতশ্রী পারফরম্যান্সে শেষ অব্দি মন খারাপ করেই স্টেডিয়াম ছাড়তে হয়েছে। অনেকে তো তীব্র সমালোচনা করতে করতে মাঠ থেকে বের হয়েছেন। কলকাতার এতিহ্যবাহী মাঠ ইডেন গাডেন্সে মঙ্গলবার আরও একটি ম্যাচ খেলতে নামবে বাংলাদেশ। এবার প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। ভক্তরা আবারও আশায় বুক বাঁধছেন, এই বুঝি হারের বৃত্ত ভেঙে জয়ের ধারায় ফিরবে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা।
ফেনী থেকে কলকাতায় বাংলাদেশের খেলা দেখতে এসেছেন আসিফ হোসেন। জীবনে বহুবার বাংলাদেশের খেলা দেখে কষ্ট পেয়েছেন। হয়তো পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচেও কষ্ট নিয়েই মাঠ ছাড়তে হবে। তবুও এদিন মাঠে যাবেন আসিফ। বললেন, ‘বাংলাদেশ দলটি আমাদের। তাদের সব সময় আমাদেরই সাপোর্ট করতে হবে। তারা ভালো খেলুক, খারাপ খেলুক, তাদের পাশে আমাদেরই থাকতে হবে। এই দলই তো আমাদের অনেক আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছে। আশা করি পাকিস্তানের বিপক্ষে কিছু একটা করবে।’
চলমান বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একই কাতারে দাঁড়িয়ে। ৬ ম্যাচে খেলে বাংলাদেশের চেয়ে একটি জয় বেশি থাকলেও পারফরম্যান্স বিচারে দুই দলই সমানে সমান। যেন কে কার চেয়ে বেশি খারাপ, তারই প্রতিযোগিতা চলছে! বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে যাওয়া বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের সামনে সুযোগ সমর্থকদের ক্ষতে সামান্য প্রলেপ দেওয়ার। সেই লক্ষ্যেই সাকিব আল হাসানের দল মাঠে নামবে।