বাংলাদেশের মেয়েরা এখন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে দেশের ফুটবলে এনে দিয়েছে নতুন প্রাপ্তি। সাবিনা-সানজিদা-কৃষ্ণারা আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়েছেন দেশের ফুটবলপ্রেমীদের। কবে এমন উৎসবে মেতেছে বাংলাদেশ, খুঁজে বের করা কঠিন। আর এই সবকিছুর নেপথ্যে কাজ করেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) অক্লান্ত পরিশ্রম ও ইচ্ছাশক্তি।
প্রায় দেড় যুগ আগে, ২০০৪-২০০৫ সালের দিকে মৌলবাদীদের তোপের মুখে মেয়েদের ফুটবল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অনেক চেষ্টার পর ঢাকার কমলাপুরে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয়েছিল মেয়েদের একটি টুর্নামেন্ট। যদিও তা বেশিদূর গড়ায়নি। মাঝে কয়েক বছর ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকার পর বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের অধীনে নতুন করে শুরু হয় মেয়েদের ফুটবলের যাত্রা। একটু একটু করে দেখতে থাকে আলোর রেখা। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নারী ফুটবলের জোয়ারের সঙ্গে এসএ গেমস কিংবা সাফ ফুটবলে নিয়মিত অংশ নিতে থাকে বাংলাদেশ দল।
কিরণ বাংলা ট্রিবিউনকে সেসব দিনের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘শুরুর দিনগুলোতে আমি ও সভাপতি (কাজী সালাউদ্দিন) নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে মেয়েদের খরচ বহন করতাম। দিনে শুধু খাবারের জন্য ব্যয় হতো ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। দিনের পর দিন আমরা দিয়ে গেছি। এখন আমরা সেই ফল পেয়েছি। তাই অনেক খুশি লাগছে।’
বাফুফে যখন মেয়েদের খেলা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় হাত বাড়ায়; একটু অন্যভাবে। ২০১১ সালে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা গোল্ডকাপ ফুটবল করে তৃণমূলে নারী ফুটবলকে বাধ্যতামূলক করে দেয়। প্রায় ৬৮ হাজার স্কুলের মেয়েদের অংশগ্রহণে খেলোয়াড়ের আর অভাব হয়নি।
সেখানে অনুশীলনের সঙ্গে পড়াশোনা (স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন বাফুফের সহায়তায়) চলতে থাকে মেয়েদের। দীর্ঘমেয়াদে চুক্তিও হয়ে যায়। ফলে মেয়েরা মাসিক বেতনের মধ্যেও চলে আসে, স্থানীয় একটি ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায়। শুরুতে ৮ থেকে ১২ হাজার টাকা থাকলেও ক্ষেত্রবিশেষে ২০ হাজার টাকাও হয়েছে বেতন। এছাড়া তাদের পরিবারও পাচ্ছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা।
আর মাঠের ফুটবলের কথা ধরলে কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের নেতৃত্বে রয়েছে একঝাঁক কোচিং স্টাফ। তাদের সঙ্গে একপর্যায়ে যোগ দেন টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলি। মেয়েদের কোচিংয়ে যোগ হয় নতুন মাত্রা। দেশ-বিদেশে একের পর এক ম্যাচ খেলে ঋদ্ধ হতে থাকেন সবাই। পরবর্তী সময়ে এএফসি ও সাফের বয়সভিত্তিক আসরগুলোতে একে একে সাফল্যও আসতে শুরু করে।
এমন দিনের অপেক্ষায় ছিলেন সবাই। সফল কোচ ছোটন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আমাদের মেয়েরা শুরুতে পাস দিতে পারতো না, ফিটনেস নিয়ে সমস্যা ছিল। কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার পর ওরা আজ সর্বোচ্চ স্তরে সাফল্য পেয়েছে। আমি আসলেই আনন্দিত।’
দেশে ফিরে তারা পেয়েছেন রাজসিক সংবর্ধনা। বিমানবন্দর থেকে বাফুফে ভবনে পৌঁছান ছাদখোলা বাসে। পথের দুই ধারে হাজার হাজার মানুষের ভালোবাসায় হয়েছেন সিক্ত। এই মেয়েদের নিয়ে বাফুফে আরও বড় স্বপ্ন দেখছে। দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন তো বলেই দিয়েছেন, ‘মেয়েদের আরও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যা যা প্রয়োজন সবই করা হবে।’
সাফল্যের চূড়ায় উঠে এখন চারদিকে ফুলেল সংবর্ধনা পাচ্ছেন সাবিনা-সানজিদারা। পাশাপাশি কোটি টাকা ওপরে অর্থ পুরস্কারের হাতছানি! তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে তাদের বাড়ি-ঘরে সংস্কারের ছোঁয়া লেগেছে।
তাদের সঙ্গে দেশের অন্য এলাকা থেকে উঠে এসে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লাল-সবুজ দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন সাবিনা-সানজিদারা। এনে দিচ্ছেন আনন্দের উপলক্ষ। সামনের সেনানি তারা, আর নেপথ্যে কাজ করে চলেছে বাফুফে। তাই দেশের ফুটবল ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও মেয়েদের এই সাফল্যে নিশ্চিতভাবেই বাহবা প্রাপ্র্য বাফুফের!