বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আলোচিত কে এই গানিম?

কাতার বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন জয় করেছেন এক কাতারি। রবিবারের অনুষ্ঠানে হলিউড অভিনেতা মরগান ফ্রিম্যানের সঙ্গে মঞ্চে দেখা যায় এই তরুণকে। যার শারীরিক উপস্থিতি আবার অন্য সবার মতো স্বাভাবিক কোনও মানুষের মতো নয়। শরীরের নিম্নাংশহীন ২০ বছর বয়সী এই তরুণ বিরল এক রোগ (কডাল রিগ্রেশন সিনড্রোম) নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। ফুটবল বিশ্বকাপের পর্দা ওঠার পর এই তরুণকে নিয়েই সর্বত্র আলোচনা। সবার একই প্রশ্ন কে এই তরুণ?

কাতারে জন্ম নেওয়া এই তরুণটির নাম গানিম আল মুফতাহ। যিনি এই বছর ফিফা বিশ্বকাপের শুভেচ্ছাদূতের একজন। গত এপ্রিলে গানিমকে কাতারের পক্ষ থেকে ফিফা বিশ্বকাপের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। ২০ বছর বয়সী গানিমের জন্ম থেকেই দুই পা নেই। ‘কডাল রিগ্রেশন সিনন্ড্রোম’ রোগে আক্রান্ত তিনি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন থেকে একটি আয়াত পাঠ করেন ফিফা বিশ্বকাপের এই শুভেচ্ছাদূত।

বিশ্বকাপের উদ্বোধন মুহূর্তেও সরব উপস্থিতি ছিল তার। মার্কিন অভিনেতা মরগান ফ্রিম্যানের সঙ্গে তার সংলাপের মাধ্যমে উদ্বোধন হয়েছে এবারের ফিফা বিশ্বকাপ। পুরো পৃথিবীতে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে ফ্রিম্যান তখন জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমরা সবাই একটি তাঁবুর নিচে একত্রিত হয়েছি। কীভাবে অনেক দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতি একত্রিত হতে পারে?’ গানিম তখন পবিত্র কোরআনের সুরা হুজরাতের ১৩নং আয়াত পাঠ করে এর অনুবাদ তুলে ধরেন এভাবে, ‘হে মানুষ, আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছি নারী ও পুরুষ থেকে, আমি তোমাকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মধ্যে বিভক্ত করেছি যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি সম্মানিত যে বেশি আল্লাহভীরু, আল্লাহ সবকিছু জানেন ও সব বিষয়ে অবগত। ’

মর্গান ফ্রিম্যানকে না হয় সবাই চেনেন। কিন্তু তার সঙ্গে থাকা সেই কাতারি তরুণের পরিচয় নিয়েই সবার কৌতুল। কী তার পরিচয়? কেনই বা তাকে নিয়ে এত তোলপাড়? শারীরিক দিক থেকে আর দশটা সুস্থ-সবল মানুষের মতো না হয়েও গানিম হয়ে উঠেছেন উপসাগরীয় অঞ্চলের বহু মানুষের অনুপ্রেরণা। কাতারের তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি একজন আইকন।

জন্মের সময়ই কডাল রিগ্রেসন সিনড্রোম নামক একটি বিরল রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে গানিমের দুই পাসহ নিম্ন মেরুদণ্ডের বিকাশ ব্যাহত হয়েছে। তারপরও শারীরিক প্রতিকূলতা তাকে আটকাতে পারেনি। ছোটবেলা থেকে শারীর নিয়ে অনেক কথা শুনতে ও বলতে হয়েছে। সহপাঠী-বন্ধুদের বোঝাতেন, অসম্পূর্ণ শরীরের জন্য তিনি মোটেও দায়ী নন। সৃষ্টিকর্তা যেভাবে পাঠিয়েছেন, তা নিয়েই সন্তুষ্ট তিনি। শত প্রতিকূলতা ও বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এখনও পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা করছেন এবং ভবিষ্যতে একজন কূটনীতিবিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।

গানিম আল মুফতাহর আরও একটি উল্লেখযোগ্য পরিচয় হলো, সামাজিক মাধ্যমে তিনি ভীষণ পরিচিত মুখ। ইনস্টাগ্রামে তার ৩ মিলিয়ন অনুসারী এবং টিকটকের জনপ্রিয়তা তো রয়েছেই। ইতিবাচক কথা বলতে বলতেই হয়ে গেছেন মোটিভেশনাল স্পিকারও। এখন অনেক মানুষের অনুপ্রেরণার উৎসও তিনি।

গানিমের জীবন শুরু হয়েছিল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। অনেকেই গানিমের মাকে বলেছিলেন গর্ভপাত করতে, কিন্তু গানিমের মা সেটি পাত্তা না দিয়ে সন্তানকে জন্ম দিয়েছেন। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, এই শিশু ১৫ দিনের বেশি বাঁচবে না! চিকিৎসকদের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করে গানিম শুধু বেঁচেই থাকেননি, বহু মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস। এই মুহূর্তে তিনি কাতারের সর্বকনিষ্ঠ উদ্যোক্তা, রয়েছে আইসক্রিমের ব্যবসাও।

শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও গানিম যে থেমে নেই এই জায়গাতেই তিনি অনন্য। একাধিক খেলায় অংশ নিয়েছেন। পা না থাকলেও কেবল হাতের সাহায্য নিয়েই অনেক ধরনের কাজ করতে পারেন, এমনকি গাড়িও চালাতে পারেন। নিজেকে সাঁতার, স্কুবা ডাইভিং, স্কেটবোর্ডিং রক ক্লাইম্বিংয়ের মতো বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রেখেছেন। বিস্ময়করভাবে সমগ্র উপসাগরীয় অঞ্চলের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জেবেল শামসও জয় করার গৌরব অর্জন করেছেন তিনি!

২০০৯ সালে টোয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি লিডার্স ফাউন্ডেশন কর্তৃক একজন আনসাং হিরো বা অদৃশ্যে থাকা বীরের স্বীকৃতি পেয়েছেন। ২০১৪ সালে কুয়েতের আমির শেখ সাবাহ আল-আহমদ আল-সাবাহ তাকে নিযুক্ত করেন শান্তির দূত। কাতার ফিন্যানসিয়াল সেন্টার কর্তৃপক্ষের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরের দায়িত্ব পালনসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন সম্মাননা পুরস্কার ও পদ লাভ করেছেন। গানিম এখন প্যারালিম্পিয়ান হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।