আকাশি-নীল সাদা উৎসব নাকি ফ্রান্সের টানা দুই

আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স এইরেস থেকে ৩শ’ কিলো দূরের গ্রাম রোজারিও। পারানা নদীর ধারের সেই ছোট্ট শহরের প্রতিটা বাড়ির দেয়ালে মেসির ছবি। সব রাস্তায় উড়ছে মেসির ১০ নম্বর জার্সি। হুট করে যে কেউ সেখানে গেলে মনে হতেই পারে এ শহরের মানুষ কি ঘরে থাকে না। তারা ঘরে থাকবে কী করে!  ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে মোড়ে মোড়ে প্রার্থনায় বসেছে গোটা গ্রামের মানুষ। রোজারিওর তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা আর্জেন্টিনায়, সারা পৃথিবীতে। এই গ্রামেরই সন্তান লিওনেল মেসি। যার দিকে আজ চেয়ে থাকবে শতকোটি চোখ।

আজ কি তিনি ঘুচাতে পারবেন আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের খরা। নাকি টানা দুটো বিশ্বকাপ জয়ের বিরল রেকর্ড গড়বে ফ্রান্স? ফুটবল যেখানে ধর্মের মতো সেই আর্জেন্টিনার মানুষ অবশ্য দ্বিতীয় ভাবনাটা ভাবতেই চান না। ৩৬ বছর আগে ডিয়েগো বিশ্বকাপ এনে দেওয়ার পর তাকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছিল আর্জেন্টাইনরা। সে জায়গাটা মেসিকে দিতে উন্মুখ আর্জেন্টিনা। মেসি কি পারবেন ফুটবল ঈশ্বর হয়ে উঠতে? নাকি টানা দুটো বিশ্বকাপ জিতিয়ে সর্বকালের সেরা কে—এই বিতর্কে নিজের নামটাও ঢুকিয়ে দেবেন কিলিয়ান এমবাপ্পে? উত্তর মিলবে আজ রাতে। কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে। খেলা শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায়।

পরিসংখ্যান কি বলে

এই নিয়ে ষষ্ঠবার ফাইনাল খেলবে আর্জেন্টিনা। আলবেসিলেস্তেদের থেকে বেশি ৮ বার ফাইনাল খেলেছে একমাত্র জার্মানি। তবে ফাইনালে হারের রেকর্ডে যৌথভাবে জার্মানির সঙ্গে প্রথম স্থানে আর্জেন্টিনা। দুই দলই ফাইনালে হেরেছে ৪ বার করে।

অন্যদিকে চতুর্থবারের ফাইনালে ফরাসিদের চোখ তৃতীয় ট্রফিতে। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ থেকে এখন পর্যন্ত ৭টি বিশ্বকাপের ৪টিতেই ফাইনাল খেলছে লা ব্লুজরা। ইতালি ও ব্রাজিলের পর ব্যাক টু ব্যাক ট্রফি জয়ের সুযোগ ফ্রান্সের সামনে। এর আগে ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ সালে ইতালি, ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে ব্রাজিল টানা দুবার বিশ্বকাপ জিতেছিল।

বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত তিনবার দেখা হয়েছে আর্জেন্টিনা-ফ্রান্সের। তার মধ্যে গত বিশ্বকাপের শেষ ষোলোতে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। আর বাকি দুটিতে হেরেছিল ফ্রান্স।

সব মিলিয়ে দুদলের মুখোমুখি দেখা হয়েছে ১২ বার। তাতে জয়ের পাল্লা ভারি আর্জেন্টিনার। ফ্রান্স জিতেছে মাত্র ৩টিতে, আর্জেন্টিনা ৬টিতে আর বাকি ৩টি ম্যাচ ড্র।

বিশ্বকাপে দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলোর বিপক্ষে ফ্রান্স ১০ ম্যাচ ধরে অপরাজিত। সবশেষ হেরেছিল ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ২-১ গোলে। এই নিয়ে লাতিন আমেরিকা-ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মধ্যকার ১১তম ফাইনাল হতে যাচ্ছে। আগের ১০ বারের মধ্যে ৭ বারই জিতেছে ল্যাতিন দলগুলো।

এগিয়ে কে?

চার বছর আগে রাশিয়া বিশ্বকাপে ফরাসিদের কাছে হেরেই রাউন্ড অব সিক্সটিন থেকে ছিটকে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। ম্যাচে একটা সময় ২-১ গোলে লিড নিয়েও শেষরক্ষা হয়নি। ৪-৩ ব্যবধানে হেরে চোখের জলে মাঠ ছেড়েছিলেন মেসি-ডি মারিয়ারা। এমবাপ্পের গতি আর গ্রিজম্যানের বুদ্ধিদীপ্ত ফুটবলের উত্তরই ছিল না সাম্পাওলির কাছে।

যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, শক্তির নিরিখে গতবারের তুলনায় এই ফ্রান্স দলে ভারসাম্য কিছুটা হলেও কম। আপফ্রন্টে এমবাপ্পে, গ্রিজম্যান, জিরুদরা দুরন্ত ছন্দে থাকলেও মাঝমাঠে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলারের অনুপস্থিতিতে কিছুটা হলেও দুর্বল ফ্রান্স। তার ওপর, একের পর এক ফুটবলার ক্যামেল ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় বেশ টেনশনে রয়েছে টিম ম্যানেজমেন্ট।

অন্যদিকে সেই তুলনায় এবারের আর্জেন্টিনা দল অনেক বেশি সংঘবদ্ধ। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই ফুল ফোটাচ্ছেন লিও মেসি। যোগ্য সঙ্গতে জুলিয়ান আলভারেজ, এনজো ফার্নান্দেজ, রদ্রিগো ডি পলরা। চোট সারিয়ে ফাইনালে শুরু থেকে মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়াও।

রক্ষণে অভিজ্ঞ ওটামেন্ডির সঙ্গে ভরসা জোগাচ্ছেন মোলিনা, লিসান্দ্রো মার্টিনেজরা। আর গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ হয়ে উঠেছেন দুর্ভেদ্য। ফাইনালে ওঠার পথে ছটি ম্যাচের মধ্যে তিনটিতে ক্লিনশিট রেখেছে আর্জেন্টিনা।

তবে এমবাপ্পের মতো ক্ষুরধার ফুটবলারের উপস্থিতি যে যেকোনও ডিফেন্সের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

চলতি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ছয়টি ম্যাচের মধ্যে চারটিই লুসেইল স্টেডিয়ামে খেলেছে আর্জেন্টিনা। রবিবার ফাইনালও এই মাঠেই। ফ্রান্স এখন পর্যন্ত লুসাইলে খেলেনি। ফলে পরিবেশ ও মাঠের চরিত্র বোঝার ক্ষেত্রে অ্যাডভান্টেজ পজিশনে থাকবে আলবেসিলেস্তরা।

মেসি বনাম এমবাপ্পে

তারা দুজন ক্লাব সতীর্থ। প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ে দুজনে পাশাপাশি আনন্দ ভাগ করে নেন। লিওনেল মেসি ও কিলিয়ান এমবাপ্পে দুজনের শক্তি, দুর্বলতা সম্পর্কে ভালো জানার কথা।

দুজনেই এই বিশ্বকাপে গোলসংখ্যায় সমান। দুজনেরই গোল ৫টি করে। পরিস্থিতি এখন এমন, যে গোল্ডেন বুটের লড়াইয়ে মেসি এবং এমবাপ্পে রয়েছেন। পাশাপাশি গোল্ডেন বলের লড়াইতেও রয়েছেন। মেসির দিকে গোল্ডেন বলের পাল্লা ভারী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে এটা শুধু ব্যক্তিগত অর্জন। নিশ্চিতভাবেই দুজনের লক্ষ্য বিশ্বকাপ ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরা। যদিও এখানে মেসির চেয়ে এগিয়ে এমবাপ্পে। বিশ্বকাপ জয়ের সাধ পেয়েছেন তিনি। অন্যদিকে মেসি ফুটবল যতকিছু অর্জন করার সম্ভব সবই করেছেন—এক বিশ্বকাপ ছাড়া।

নজরে থাকবের আরও যারা

দুদলের শীর্ষ ফর্মে থাকা খেলোয়াড়রা জুলিয়ান আলভারেজ চারটি গোল করে মেসির অ্যাসিস্টের প্রবল সুবিধা পেয়েছেন। অন্যদিকে অলিভিয়ার জিরুদ দুর্দান্তভাবে দলকে সহায়তা করছেন। তিনিও মেসি-এমবাপের চেয়ে ১ গোল পিছিয়ে ৪ গোল নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন। আছেন ফরাসি মিডফিল্ডের প্রাণ আন্তোনিও গ্রিজম্যান, টুর্নামেন্টে গোল না পেলেও তিনটি অ্যাসিস্ট রয়েছে তার। আর বল সাপ্লাই পেতে তার দিকেই তাকিয়ে থাকেন এমবাপ্পেরা।। দুই দলের আক্রমণভাগ দুর্দান্ত তাই গোলবারের সামনে লরিস বনাম মার্টিনেজের লড়াইয়ে যিনি এগিয়ে থাকবে বিশ্বকাপ উঠতে পারে তার হাতেও।

তবে আর্জেন্টিনার জন্য সবচেয়ে ভরসায় জায়গা মেসি-আলভারেজ রসায়ন। খেতাবি লড়াইয়ে ফ্রান্সের বিপক্ষে বিজয় পতাকা ওড়াতে হলে মেসি-আলভারেজ জুটিকেই আরও একবার জ্বলে উঠতে হবে। তবেই পূর্ণ হতে পারে লিও মেসির অধরা মাধুরী লাভের স্বপ্ন। আর ব্যর্থ হলে ইতালি ব্রাজিলের পর বিশ্বের তৃতীয় দেশ হিসেবে টানা দুটো বিশ্বকাপ জিতবে ফ্রান্স।