‘দাবাড়ু হিসেবে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি’

তিনি বাংলাদেশের দাবার কিংবদন্তি। মাত্র ২১ বছর বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ তো বটেই, উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ ৫৩ বছর বয়সেও অদম্য। সদ্যসমাপ্ত জাতীয় দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ৬৪ ঘরের খেলাটির প্রতি আজও তার অনন্ত ভালোবাসা। তবে দাবা নিয়ে কিছু আক্ষেপ-হতাশাও আছে নিয়াজের। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে প্রকাশিত হলো অনেক কিছুই।

জাতীয় দাবায় ষষ্ঠ শিরোপার স্বাদ পেয়েছেন নিয়াজ মোর্শেদবাংলা ট্রিবিউন: ৫৩ বছর বয়সে জাতীয় দাবার শিরোপা জিতলেন। রহস্য কী?

নিয়াজ মোর্শেদ: রহস্য কিছুই না, আমি আমার মতো খেলে গেছি। নিজের খেলাটা খেলতে পেরেছি বলেই ষষ্ঠবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। তবে এবারের শিরোপা জয়ের আনন্দ অন্যরকম। এই বয়সে দাবায় নতুন করে উৎসাহ পাচ্ছি।

বাংলা ট্রিবিউন: ২০১২ সালে সবশেষ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। এবার তো আপনি সহ দেশের পাঁচজন গ্র্যান্ডমাস্টারই খেলেছেন। এবারের প্রতিযোগিতা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?

নিয়াজ: হ্যাঁ, সবশেষ যখন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম, তখন দুজন গ্র্যান্ডমাস্টার খেলেনি। এবার সবাই খেলেছে। নতুন খেলোয়াড়রাও ছিল। ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। আমি প্রতিযোগিতার শুরু থেকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে খেলেছি।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছিলেন ১৯৮৭ সালে। এরপর আরও চারজন গ্র্যান্ডমাস্টার পেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু গত ১১ বছরে আর কোনও জিএম আসেনি। কেন?

নিয়াজ: আসলে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি। যেভাবে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সেভাবে দাবা এগোতে পারেনি। বর্তমানে দেশে ১৫ থেকে ২০ জন জিএম থাকতে পারতো। এই ব্যর্থতার পেছনে সাংগঠনিক অদক্ষতা একটা বড় কারণ।

বাংলা ট্রিবিউন: তাহলে কী দাবায় কোনও ভবিষ্যত নেই?

নিয়াজ: ঠিক তা নয়, আমি এখনও আশাবাদী। নতুন দাবাড়ুরা উঠে আসছে। ফাহাদ রহমান আর মনন রেজা নীড় যথেষ্ট প্রতিভাবান। তাদের ঠিকমতো পরিচর্যা করা হলে কয়েক বছরের মধ্যে গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারবে।

বাংলাদেশের দাবা নিয়ে তিনি আশাবাদীবাংলা ট্রিবিউন: আপনি তো উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার, অনেকেরই রোল মডেল। এটাকে কীভাবে দেখেন?

নিয়াজ: হ্যাঁ, এখনও যেখানে যাই, অনেকেই আমাকে সম্মান জানায়। সেজন্য গর্ববোধ করি। দেশে বা দেশের বাইরে খেলা কিংবা কোচিং করানোর সময় সবার ভালোবাসা দারুণ উপভোগ করি।

বাংলা ট্রিবিউন:  উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে আপনার তো অনেক দূর যাওয়ার কথা ছিল। আপনার পরে জিএম হয়ে ভারতের বিশ্বনাথন আনন্দ ছয়বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।

নিয়াজ:  দেখুন আনন্দের মতো ঝলমলে ক্যারিয়ার বিশ্বে কম দাবাড়ুরই আছে। একসময় তার সঙ্গে নিয়মিত খেলতাম। সে হলো লিজেন্ডারি দাবাড়ু। সবাই তো আনন্দ হতে পারবে না। আমি পড়াশোনা সহ নানা কারণে দাবায় সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারিনি। তেমন স্পন্সরও পাইনি। এত সমস্যা নিয়ে দাবা খেলা চালিয়ে যাওয়া কঠিন।

বাংলা ট্রিবিউন: ক্যারিয়ার নিয়ে কোনও আক্ষেপ আছে?

নিয়াজ:  আক্ষেপ তো আছেই। আবার ক্যারিয়ার শুরু করতে পারলে নতুন করে নিজেকে তৈরি করতে পারতাম। কত দূর যেতে পারতাম তা বলা কঠিন। তবে সঠিক গাইডেন্স পেলে হয়তো আরও ভালো করতে পারতাম।

বাংলা ট্রিবিউন:  দাবা নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?

নিয়াজ:  যত দিন সম্ভব খেলা চালিয়ে যেতে চাই, দাবায় ভালো কিছু দেখতে চাই। দাবায় কিছুটা স্থবিরতা এসেছে যা দূর করতে হবে, ৫/৭ বছর ধৈর্য ধরে কাজ করতে হবে। সবার সহযোগিতা পেলে এদেশের দাবাকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। এখন কেউ জিএম হলে দাবা নিয়ে অনেকের মনে আগ্রহ জন্মাবে। আসলে একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হয়। ভিশন না থাকলে এগোনো সম্ভব নয়।

একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোনোর পরামর্শ নিয়াজেরবাংলা ট্রিবিউন: কখনও কী মনে হয়েছে দাবা না খেলে ফুটবল কিংবা অন্য খেলায় মনোযোগ দিলে ভালো হতো?

নিয়াজ:  আমার কখনও সেটা মনে হয়নি। দাবাড়ু হিসেবে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি আমি। সবাই আমাকে চেনে-জানে, সম্মান জানায়।

বাংলা ট্রিবিউন: শেষ প্রশ্ন। দাবাকে কি পেশা হিসেবে নেওয়া সম্ভব?

নিয়াজ: না, এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। হয়তো ভবিষ্যতে সুযোগ আসবে। সেজন্য নতুন রোল মডেল প্রয়োজন। তবে আমি স্বপ্ন দেখি একসময় দাবা অনেক জনপ্রিয় হবে, চারদিকে দাবা নিয়ে হৈচৈ পড়ে যাবে।